রায়বাহাদুর আবার কুঞ্চিত করলেন বিরক্তিতে। শব্দটা তাঁরও কানে এসেছে। বড়ো বেশি প্রত্যক্ষ, বড়ো বেশি বাস্তব। মানুষের ক্ষুধাটা বড়ো বেশি নগ্ন। এক মুহূর্ত ভুলে যাওয়ার জো নেই, তলিয়ে যাওয়ার উপায় নেই কোথাও। কোথায় তাহিতি-ম্যানিলাহনোলুলুর জাদুরাজ্য, আর কোথায়…
কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল তাঁর দরজায় দুটো করালদর্শন এবং করালদশন কুকুর। নতুন গিনির মত ঝকঝকে পিঙ্গল চোখ মেলে তারা পাহারা দিচ্ছে, কোনো অনাহূত রবাহুতের সাধ্য নেই তাদের সতর্ক প্রহরী এড়িয়ে এ রাজ্যে অনধিকার প্রবেশ করে। এ জাদুমন্ত্রের দেশ। বাইরের পৃথিবীতে যত ক্ষুধাই উত্তাল হয়ে উঠুক-না কেন, এখানকার ফুলের গন্ধ, রায়বাহাদুরের হাতের জ্বলজ্বলে হিরাখানা অথবা নীল পর্দার গায়ে বিদ্যুতের আলো কোনোখানে তার এতটুকুও বৈলক্ষণ দেখা দেবে না।
এই হাড়গুলো আমার বহু যত্নের কালেকশন। অনেক আছে, প্রত্যেকটারই এইরকম সমস্ত গুণ। প্যাসিফিক ঘুরবার সময় এগুলো সংগ্রহ করাই হবি ছিল আমার। ভাবছি এই নিয়ে বই লিখব একখানা।
কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। কেবলই মনে হচ্ছে একটা অমানুষিক গন্ধ আসছে নাকে, আগুনের গন্ধ, পোড়া মাংসের গন্ধ। পালাতে পারলে যেন বেঁচে যাই। কিন্তু চাকরিটা! রায়বাহাদুরের কলমের এক আঁচড়, মাত্র একটি আঁচড়েই সেটা হয়ে যেতে পারে।
হাড় জোগাড় করেছি, কিন্তু মন্ত্রগুলো পাইনি। সেগুলো অনধিকারীকে শেখায় না ওরা। যদি পাওয়া যেত… রায়বাহাদুর হাসলেন, যদি পাওয়া যেত তাহলে এতদিনে কত কী অঘটন ঘটিয়ে বসতাম কে জানে। হয়তো সমস্ত পৃথিবীর চেহারাই বদলে যেত মন্ত্রবলে। আর এই যে ছোট্ট দাঁতটা দেখছ, এটা…।
অস্থিরাজ্য থেকে যখন মুক্তি পেলাম, রাত তখন ন-টার কাছাকাছি।
উপসংহারে রায়বাহাদুর বললেন, ইয়াং ম্যান, কেন পঞ্চাশ-ষাট টাকার চাকরির জন্য ঘোরাঘুরি করছ? বি কারেজিয়াস। ভাগ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো, নাম লেখাও অ্যাকটিভ সার্ভিসে। সামনে পড়ে রয়েছে সমুদ্র, পড়ে রয়েছে পৃথিবী। কেরানিগিরি করে কী হবে?
ক্লান্ত নিরাশ গলায় বললাম, তা বটে, কিন্তু চাকরিটা পেলে…
ওই চাকরি চাকরি করেই উচ্ছন্নে গেল দেশটা। রায়বাহাদুর উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন, তুমি প্রমথর ছেলে। তোমার বাবা হোয়াট এ প্লেনড্ডি বয় হি ওয়াজ। বাপের নাম রাখতে হবে তোমাকে। একটা নগণ্য কলমপেষার চাকরির মধ্যে নিজের সমস্ত ফিউচারকে নষ্ট করে দিয়ো না। আই উইশ ইউ অল সাকসেস ইন লাইফ। আচ্ছা, গুড নাইট।
নমস্কার
ব্ল্যাক আউটের আলোহীন পথ। উপদেশের বোঝা ঘাড়ে করে ভারী পায়ে চললাম এগিয়ে। টিউশনিতে আজ আর যাওয়া হল না। ছাত্রের বাবা মহাজন লোক, পাইপয়সা বাজে খরচ করেন না। এক দিনের মাইনে কেটে নেওয়া বিচিত্র নয়।
সামনে ডাস্টবিন। পাশের অবগুণ্ঠিত ল্যাম্পপোস্ট থেকে একটা ছোটো আলোকচক্র পড়েছে তার ওপর। তিন-চার জন অমানুষিক মানুষ তার ভেতর হাত ডুবিয়ে খুঁজছে খাদ্য। একটু দূরেই একটা কঙ্কালসার কুকুরের ছায়ামূর্তি, নতুন প্রতিযোগীদের কাছে ভিড়বার ভরসা পাচ্ছে না। কাঠির মতো হাত-পা আর বেলুনের মতো পেটওয়ালা একটা ছোটো ছেলে দু হাতে কী চুষছে প্রাণপণে। হাড়? হ্যাঁ, হাড়ই তো।
আমি থমকে থেমে দাঁড়ালাম। কোথায় একটা সাদৃশ্যবোধ। সেই বলি-দেওয়া কুমারী মেয়ের হাড়খানার মতোই দেখতে। যার গুণে তাহিতির আকাশে রুধিরাক্ত মেঘ ভেসে ওঠে, ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের ঝাপটা বয়ে যায়, ঝরঝর করে ঝরে তাজা রক্তের বৃষ্টি। কলকাতার আকাশেও কি মেঘ করেছে! ভালো করে তারাগুলোকে দেখতে পাচ্ছি না। ওই কালো আকাশের রং আগুনের মতো লাল হয়ে উঠবে কবে, এই ল্যাগনোলিয়ার গন্ধজড়িত মিঠে হাওয়ায় ঝোড়ো আগুনের ঝলক লকলক করে বয়ে যাবে কবে?
হাড় ওরা পেয়েছে, কেবল মন্ত্র পাওয়াটাই বাকি।
হারপুন
সাহিত্যিক রামগতিবাবু কলকাতার বাইরে বেড়াতে এলেন।
কলকাতার গণ্ডগোলে ভদ্রলোকের যেন দম আটকে যাওয়ার জো হয়েছিল। লেখার তাগিদ, প্রকাশকের তাড়া, সভাসমিতির হাঙ্গামা উঃ। এর মধ্যে মানুষ বাঁচে কখনও। এইবারে নিশ্চিন্তে একটি মাস কাটিয়ে যাবেন এখানে। বেড়াবেন, ঘুমোবেন, নিজের হাতে বাজার করে ইচ্ছেমতো খাওয়া-দাওয়া করবেন আর সময় সুযোগ মতো মনের আনন্দে দুটো একটা গল্প কবিতা লিখবেন।
বাসাটিও পেয়েছেন বেশ মনের মতো। ছোট বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। সামনে লন আর ফুলের বাগান বড় বড় গোলাপ ফুটে বাগান যেন আলো হয়ে আছে। বসবার জন্যে পাথরের বেদী। সেখানে বসলে দূরে নীল পাহাড়ের সারি দেখা যায় তাদের কোলে মেঘ খেলে বেড়াচ্ছে আর ছোট্ট একটি নদী পাহাড়ের বুক চিরে রুপোর পৈতের মতো নেমে এসেছে।
বিকেলবেলা রামগতিবাবু লনের বেদীতে বসে এক পেয়ালা চায়ে চুমুক দিয়েছেন আর পাহাড়ের শোভা দেখছেন, এমন সময় শুনতে পেলেন, আসতে পারি, স্যার?
রামগতিবাবু মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, বছর বাইশেকের একটি ছেলে। পরনে পাজামা, গায়ে ঝোলা আদ্দির পাঞ্জাবি, কাঁধে শাদা শাল। ঘাড়ের দু’পাশে বাবরি চুল, নাকের তলায় সরু একটি গোঁফের রেখা।
ছেলেটি আবার বললেন, আসব স্যার?
গেট পেরিয়ে ভেতরে যখন ঢুকেই পড়েছে তখন না আসতে বলার কোনও মানেই হয় না। রামগতিবাবু বললেন, আসুন–আসুন।