সবুজ পর্দা সরিয়ে একটা ট্রে নিয়ে বেয়ারা ঘরে ঢুকল। চা, খাবার। পিতৃদেবের বন্ধুত্বটা রায়বাহাদুর সত্যি সত্যিই মনে করে রেখেছেন দেখা যাচ্ছে। এ যাত্রা বোধ হয় হয়েই যাবে চাকরিটা।
রায়বাহাদুর বললেন, নাও।
বিনা বাক্যব্যয়ে একটা প্লেট কাছে কেটে নিলাম। খিদেও পেয়েছে বিলক্ষণ। বেলা এগারোটায় মেস থেকে খেয়ে বেরিয়েছি, বেলা সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে এখন। এর মধ্যে এক কাপ চা খাইনি, একটা সিগারেট পর্যন্ত নয়।
দূরে আবার সেই বুভুক্ষুদের চিৎকার—ডাস্টবিন উলটে ফেলে দিয়ে যেমন করে সচিৎকারে ঝগড়া করে কুকুরের দল। মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি ওরা গোগ্রাসে গিলছে, খিচুড়ির ড্যালা গলায় আটকে চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে, অথচ আরও পাওয়ার জন্যে অবরুদ্ধ সুরে আর্তনাদ করছে। আর আমরা এখানে চা খাচ্ছি কত মার্জিত, কত সংযত আর ভদ্রভাবে। মুখটা সিকি ইঞ্চি ফাঁক করে দাঁতের কোণে কেক কাটছি। উদ্দেশ্যটা যেন খাওয়া নয়, ঘাসের শিষ চিবানোর মতো দাঁতের একটুখানি বিলাসিতা মাত্র। চায়ের কাপে এমনভাবে চুমুক দিচ্ছি যে, এতটুকু শব্দ হচ্ছে না—ঠোঁটের আগায় আলগাভাবে চুম্বনের মতো একটু ছোঁয়াচ লাগছে। গপ গপ করে গেলা, হুসহাস করে শব্দ করা জীবনের সমস্ত এস্থেটিক আনন্দ তাতে বিস্বাদ হয়ে যায়। খাওয়াটা যেমন স্কুল, তেমনি গ্রাম্য হয়ে ওঠে।
মুখ থেকে চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রায়বাহাদুর বললেন, হ্যাঁ, কী বলছিলাম? এই হাড়খানা। বড়ো বিচিত্রভাবে সংগ্রহ করেছিলাম এটাকে। ওখানকার সর্দার এখানাকে পরত মুকুটে। কারণ যার মাথায় এই হাড় থাকবে সে হবে যুদ্ধে অজেয়, শত্রুর হাজার অস্ত্রাঘাতও তার কোনো অনিষ্ট করতে পারবে না। ওদের কোনো এক জাদুকর পুরোহিত একে মন্ত্রসিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। অনেক কষ্টে আমি এটাকে জোগাড় করি—কিউরিয়োর অপূর্ব নমুনা হিসেবে। ওয়েল ইয়ং ম্যান, জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস কর তুমি?
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে ঘরের মধ্যে। মনোহরপুকুর পার্ক থেকে অবিচ্ছিন্ন চিৎকার। জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করি বই কী। শস্যশ্যামল লক্ষীর ভান্ডার বাংলা! হরিবর্মদেব, শশাঙ্ক, নরেন্দ্রের তলোয়ার-ঝলসিত বাংলা। কার মন্ত্রবলে সেই বাংলা থেকে উঠে এল এই প্রেতের দল? মাঠভরা ফসল কার মন্ত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে মিলিয়ে গেল? একটি কণাও পড়ে রইল না কোনোখানে। জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস না করে উপায় কী?
বললাম, হ্যাঁ, ইয়ে—কতরকম ব্যাপারই তো আছে, বিজ্ঞান দিয়ে তার…
দেয়ার ইউ আর… দু-নম্বরের হাড়খানা হাতে তুলে রায়বাহাদুর বললেন, আমিও সেই কথাই বলছি। স্টিভেনশনের সেইসব গল্পগুলো পড়নি? দেখতে দেখতে একটা সাধারণ মানুষ সাড়ে তিনশো হাত লম্বা হয়ে ওঠে, বড়ো বড়ো পা ফেলে পার হয়ে যায় সমুদ্র, আর জলের তলায় নিমজ্জিত সব নাবিকদের কঙ্কালগুলো সেই অতিকায় পায়ের চাপে গুড়িয়ে যায় মড়মড় করে। তাহিতির আকাশে ঝড়ের কালো মেঘ রক্তের মতো রাঙা হয়ে ওঠে, খ্যাপা বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের হলকা বয়ে যায়, আকাশ থেকে যে বৃষ্টির ধারা নেমে আসে, তা জল নয়, টকটকে তাজা রক্তের ফোঁটা। আর কেমন করে হয় জান? এইরকম, ঠিক এমনি একখানা হাড়ের গুণে।
ভীত শঙ্কিত দৃষ্টিতে আমি সেই হাড়ের দিকে তাকালাম। অন্য সময় হলে এসব কথা গঞ্জিকার মহিমাপ্রসূত মনে হত, কিন্তু সমস্ত আবহাওয়াটাই যেন এই সমস্ত কাহিনির জন্যেই প্রস্তুত হয়ে আছে। ঘরের মধ্যে জ্বলছে জোরালো বিদ্যুতের আলো। গ্রাণ্ডিফ্লোরা আর রায়বাহাদুরের পাইপ থেকে কড়া তামাকের গন্ধ। হাওয়ায় জানালার নীল পর্দাগুলো প্রশান্ত মহাসাগরের নীল তরঙ্গমালার মতো দোল খাচ্ছে। রায়বাহাদুরকে মনে হল যেন অপরিচিত দেশের সেই অদ্ভুতকর্মা যাদুকর, তাঁর হাতের হাড়ে মুহূর্তে ভেলকি লাগতে পারে।
পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় পুজো করে কুমারী মেয়েকে বলি দেয় ওরা। তারপর তাকে পুড়িয়ে হাড়গুলো যা থাকে তা মাটির তলায় পুঁতে দেয়। সাত বছর পরে মহাসমারোহে সে হাড় তুলে আনা হয়, ফেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে। সে-হাড় যে জলের তলা থেকে তুলে আনতে পারে সে-ই হয় এই জাদুবিদ্যার মালিক। যত প্রেতাত্মা সব তার অনুচর হয় তখন, সে যা খুশি তাই করতে পারে। তাল তাল পাথর তার ক্ষমতায় সোনা হয়ে যায়, তার আদেশে লতাপাতাগুলো অজগর সাপ হয়ে ফণা তুলতে পারে।
আমি বসে রইলাম মন্ত্রমুগ্ধের মত। রায়বাহাদুরের চোখ দুটো জ্বলছে, হাতের হিরাটা জ্বলছে, জ্বলছে বলি-দেওয়া সেই কুমারী মেয়ের হাড়খানা, নীল পর্দাগুলো জ্বলছে, আগুনের মতো জ্বলছে অতি তীব্র শক্তির বৈদ্যুতিক আলোটা। সমস্ত ঘরটা যেন জ্বলন্ত। আর সেই জ্বলন্ত ঘরের মাঝখানে মিলিয়ে যাচ্ছে ম্যাগনোলিয়ার গন্ধ, পাইপের তামাকের গন্ধ, ভেলভেটের বাক্স থেকে উঠে আসা কী-একটা ঔষধ-গন্ধ। মনে হল যেন আমার সামনে একটা আগুনের কুন্ড জ্বলছে, তার লকলকে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে একতাল কাঁচা মাংস। তামাটে ধোঁয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে দগ্ধ মেদ আর চুলের অত্যুগ্র দুর্গন্ধ, যেন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।
চাট্টি ভাত দাও মা, একটুখানি ফেন।
মোহ ভেঙে গেল মুহূর্তে। তাহিতি দ্বীপে মানুষ পুড়ছে না, পুড়ছে কলকাতায়। বুভুক্ষার লেলিহান শিখায়। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে বিরাম নেই ট্রাফিকের। ট্রাম চলছে, মোটর চলছে, চলছে স্বপ্নসম লোকযাত্রা। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে ওই চিৎকার এসে ঘা দিচ্ছে কানে। কী অস্বাভাবিক গলার জোর, কী দানবীয় আর্তনদ! মরবার আগে মানুষের গলার স্বর কি ওইরকম গগনভেদী হয়ে ওঠে!