নিরুত্তর হয়ে থাকা ছাড়া আর কী করা যায়। পিতৃ-প্রশংসায় বিনীত হয়ে থাকাই উচিত ভক্ত সন্তানের।
তারপর? চাকরি পাচ্ছ না যুদ্ধের বাজারে? এমএ পাস করে কেরানিগিরির উমেদারি করছ? বি এ ম্যান ইয়াং ফ্রেণ্ড, বেরিয়ে পড়ো অ্যাডভেঞ্চারে। চাকরি নাও অ্যাক্টিভ সার্ভিসে, ভিড়ে পড়ো নেভিতে।
বললাম, নানারকম অসুবিধে আছে, অনেককে দেখাশোনা করতে হয়। তা ছাড়া একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে…
অনিশ্চিত! তীক্ষ্ণহয়ে উঠল রায়বাহাদুরের দৃষ্টি। জীবনটাই তো অনিশ্চিত হে ছোকরা। আমিও একদিন নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম অনিশ্চিয়তার মধ্যে। সিঙ্গাপুরে কাটিয়েছি দশ বৎসর, ভেসে গেছি হাওয়াই, ম্যানিলা, তাহিতি, ফিলিপাইন, মিকাদোর দেশে জাপানে। পৃথিবীটাকে চোখ মেলে না দেখলে বাঁচবার অর্থ নেই কোনো।
তা বটে। আমি ক্লিষ্টভাবে হাসলাম। রায়বাহাদুরের কথাগুলো ভালো, অত্যন্ত মূল্যবান। অ্যাডভেঞ্চার নেই বলেই তো বাঙালির সমস্ত প্রতিভা ব্যর্থ হয়ে গেল। কিন্তু ভালো কথা জানলেই কি ভালো হওয়া যায়? যুদ্ধকে ভয় করি আমি, সাইরেনের শব্দে আমার বুকের ভেতরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। ইউ-বোট বিঘ্নিত ফেনিল সমুদ্রে নিরুদ্দেশযাত্রা আমাকে কবিকল্পনায় উদবুদ্ধ করে তোলে না। তা ছাড়া পৈত্রিক অর্থে প্রশান্ত মহাসাগরের স্বপ্নরাজ্যে ভেসে-বেড়ানো, আর বোমারু ইগলের মৃত্যুচঞ্চর তলায় দূরবিনের শানিত চোখ মেলে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট নিয়ে প্রতীক্ষা করা—আমার সন্দেহ হয় এ দুটোর মধ্যে অনেকখানি অসংগত ব্যবধান আছে।
পাইপে আগুন ধরিয়ে রায়বাহাদুর বললেন, কত জায়গাতে ঘুরেছি আমি। হাওয়াইয়ের সেই হুলহুলা ড্যান্স, স্টিভেনশন ব্যালেন্টাইনের প্রবালদ্বীপের দেশ, ফিলিপাইনের জাদুবিদ্যা। বিচিত্র সব কালেকশন আমার, দেখবে?
কালেকশন দেখবার মতো মনের অবস্থা নয়। পঁচিশ টাকার প্রাইভেট টিউশন আছে একটা, এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে সেই উদ্দেশ্যে। কিন্তু পিতৃবন্ধু রায়বাহাদুরকে চটানো চলে না, তাঁর কলমের একটা আঁচড়েই হয়ে যেতে পারে চাকরিটা।
উঠে জোরালো একটা ইলেকট্রিকের আলো জ্বালনের রায়বাহাদুর। তারপর ঘরের এক কোণের একটা লোহার আলমারি খুললেন তিনি। তাঁর ড্রয়ার থেকে বেরিয়ে এল কালো ভেলভেটের একটা বাক্স, সেটা এনে রাখলেন আমার সামনে। ঢাকনাটা খুলে বললেন, দেখছ?
দেখলাম, কিন্তু এ কী কালেকশন। কতগুলো ছোটো-বড়ো হাড়ের টুকরো। প্রত্যেকটার সঙ্গে একখানি করে নম্বরের ছোটো লেবেল ঝুলছে। আশ্বর্য হয়ে বললাম, হাড় নাকি এগুলো?
হ্যাঁ, হাড় বই কী। আমার মুখোমুখি হয়ে বসলেন রায়বাহাদুর, কিন্তু সাধারণ হাড় নয়। এদের প্রত্যেকের বিস্তৃত পরিচয় আছে, অমানুষিক সব গুণ আছে। সমস্ত প্যাসিফিক ঘুরে
আমি এদের সংগ্রহ করেছি। কিন্তু ওয়ান মিনিট প্লিজ, সুষি মাদার?
সুষি ঘরে ঢুকল। সেই মেয়েটি।
ডাকছ বাপি?
আমাদের চা?
বলছি এখুনি। নাচের ভঙ্গিতে সমস্ত তনু দেহটিতে একটা দোলা দিয়ে সুষি বেরিয়ে গেল।
রায়বাহাদুর আবার আমার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন। তারপর দামি দুর্লভ একখন্ড হিরার মতো পরম যত্নে এক টুকরো হাড় তুলে আনলেন বাক্স থেকে।
বলতে পার, কীসের হাড় এটা? নিশ্চয়ই ভয়ানক কিছুর। ভয়ে ভয়ে বললাম, গরিলা?
ননসেন্স! রায়বাহাদুর প্রচন্ড একটা ধমক লাগালেন আমাকে, প্রশান্ত মহাসাগরে গরিলা থাকে শুনেছ কখনো? এটা রোডেশিয়ানের স্বজাতীয় কোনো আদিমানবের চোয়ালের হাড়।
রোডেশিয়ান?
হ্যাঁ, রোডেশিয়ান। রায়বাহাদুর স্পষ্ট অপ্রসন্ন হয়ে উঠলেন। রোডেশিয়ানের নাম জান? অর্ধেক, অর্ধেক গরিলা, মাত্র কয়েকশো বছর আগেও পৃথিবীতে অস্তিত্ব ছিল তাদের।
বোকার মতো বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, জানি বই কী। অবচেতন মনের কাছে সুরটা যেন বাজল মোসাহেবির মতো। কিন্তু উমেদারি করতে হলে মোসাহেবি তো অপরিহার্য।
এটা সেই রোডেশিয়ান ক্লাসের কোনো জীবের হাড়, মানুষেরও বলতে পারো। কোথায় পেয়েছি জান? মিণ্ডানাও দ্বীপে কাটাবাটু বলে জায়গা আছে একটা। তারই কাছাকাছি একটা গাঁয়ের সর্দারের কাছ থেকে এই হাড় কিনেছিলাম। কত দাম দিয়ে কিনেছিলাম বলতে পারবে?
ধমক খাওয়ার ভয়ে স্পষ্ট উত্তর দিতে সাহস হল না। বললাম, অনেক দাম হবে নিশ্চয়।
নিশ্চয়। পাঁচ হাজার টাকা।
পাঁচ হাজার টাকা! রায়বাহাদুরের হাতের তেলোয় ওই বস্তুটির দিকে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি। ইঞ্চি তিনেক লম্বা, চ্যাপটা আকৃতির ছুরির ফলার মতো দেখতে। বিবর্ণ হয়ে যাওয়ায় হরিদ্রাভ রং ধরেছে—রায়বাহাদুরের বিকটকায় কুকুরগুলোর নোংরা দাঁতের মতো।
খুব বেশি মনে হচ্ছে? মোটেই নয়। এর ইতিহাস শুনলে তুমি…
দূর থেকে একটা তীব্র কোলাহলে বাকি কথাগুলো উড়ে গেল মুহূর্তে। বাইরের পথে ট্রামের শব্দ, ঘরের ঘড়িটার টিক টিক করে ছন্দবদ্ধ সুরঝংকার, সব কিছুকে ছাড়িয়ে সেই কোলাহল কানে এসে আঘাত করে। কিন্তু কলরবটা অপরিচিত নয়, কোনো অজ্ঞাত কারণে ক্ষুধার্ত জনতার সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠেছে।
রায়বাহাদুরের মুখ অপ্রসন্ন হয়ে উঠল, পার্কের ওই ডেসটিচ্যুটগুলোর জ্বালায় রাতে আর ঘুমানো যায় না। বোধ হয় খাবারদাবার কিছু মিলেছে তাই এই চিৎকার। খেতে না পেলে চিৎকার করবে, খেতে পেলেও তাই।