ফটকের বাইরে অনিশ্চিতভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। ফিরে যাব? শ্যামবাজার থেকে এতদূর পয়সা খরচ করে এসে দুটো কুকুরের সঙ্গে দেখা করেই ফিরে যাব?
রায়বাহাদুর এইচ এল চ্যাটার্জি-ইনি-ই তো বটে। কিন্তু ডাকি কাকে? দরোয়ানের ঘরটা বন্ধ। ওদিকে বাগানের একপাশে যেখানে চমৎকার গ্র্যাণ্ডিফ্লোরা ফুটেছে, একটা মালী ঝাঁঝরি হাতে সেখানে কী-যেন কাজ করছিল। আমাকে এক বারও তার চোখে পড়েছিল কি না জানি না। না-পড়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু কী করি, চাকরির উমেদার। বহু কষ্টে পরিচয়পত্র মিলেছে একখানা, পিতৃবন্ধু বলে একটা কথাও শুনেছিলাম। রায়বাহাদুর একটা কলমের খোঁচা দিয়ে দিলেই হয়ে যেতে পারে চাকরিটা। কাজেই একসময়ে আমাকে দেখে হয়তো কারও কৌতূহল উদ্ৰিক্ত হয়ে উঠবে আপাতত সেই শুভ মুহূর্তেরই প্রতীক্ষা করা যাক। গেটের সামনে পায়চারি শুরু করে দিলাম।
প্রসারিত রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। মোটর-ট্রাম-মানুষের অবিচ্ছিন্ন স্রোতোধারা। মাথার ওপর এরোপ্লেনের পাখার শব্দ—জাপানি দস্যুর আক্রমণ আশঙ্কায় পাহারা দিচ্ছে। দি লায়ন হ্যাজ উইংস!
গর-র-র
পেছনে ক্রুদ্ধ গর্জন। চমকে তাকিয়ে দেখি একটা মহাকায় কুকুর চলে এসেছে একেবারে গেট পর্যন্ত। আর লোহার রেলিঙের ভেতর দিয়ে বাইরে বের করে দিচ্ছে ভোঁতা সিক্ত নাকটা। চোখ দুটোতে সোনালি আগুন জ্বলজ্বল করছে, ঝলসে উঠছে দুটো গিনির মতো। কয়েকটা হিংস্র দন্ত বিকাশ করে আবার বললে, গর-র-র–
লক্ষণ সুবিধের নয়। শকটং পঞ্চহস্তেন-শাস্ত্রকারেরা বোধ হয় কুকুরের মহিমা টের পাননি তখনও। গেটের সামনে থেকে আরও দু-পা দূরে এলাম। আশা ছাড়তে পারছি না। উমেদারের আশা অনন্ত।
একটু দূরে মনোহরপুকুর পার্ক। আপাতত মনোহর নয়, বুভুক্ষুর কলোনি বসেছে সেখানে। নগরীর নির্মল স্ফটিক জলে জোয়ারের টানে ভেসে আসা একরাশ দুর্গন্ধ আবর্জনা। চিৎকার করছে, কলহ করছে, পরস্পরের মাথা থেকে উকুন বাছছে, জানোয়ারের মতো ঝুঁকে পড়ে কালো জিভ দিয়ে খাচ্ছে হাইড্রেনের ময়লা জল। সহানুভূতি আসে না, বেদনা আসে না, শুধু একটা অহেতুক আশঙ্কায় মনটা শিউরে উঠে শিরশির করে। দেশজোড়া ক্ষুধা যেন মা কালীর মতো রসনা মেলে দিয়েছে, এ ক্ষুধার আগুন কবে নিভবে কে জানে। একমুঠো ভাত আর এক খাবলা বাজরাই কি যথেষ্ট এর পক্ষে? আরও বেশি, আরও বেশি, এমনকী রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই ছবির মতো বাড়িগুলো পর্যন্ত?
বাতাসে একটা গন্ধের তরঙ্গ এল। না, বুভুক্ষুদের নোংরা গন্ধ নয়, গ্র্যাণ্ডিফ্লোরার উগ্রমধুর এক ঝলক সুরভি। অ্যাসফল্টের চওড়া রাস্তা, কালো মার্বেল-বাঁধানো সিঁড়ি, রঙিন কাচ দেওয়া জানালায় সিল্কের পর্দা, চীনামাটির টবে কম্পমান অর্কিড।
কাকে চাই আপনার?
মিষ্টি মধুর কণ্ঠ, ম্যাগনোলিয়ার গন্ধের সঙ্গে যেন তার মিল আছে। তাকিয়ে দেখি গেটের ওপারে কোথা থেকে একটি ষোড়শী এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্যসমুজ্জ্বল দীর্ঘকায়া একটি গৌরাঙ্গী মেয়ে। ট্রাউজারপরা, সঙ্গে ছোটো একটি সাইকেল। আবার প্রশ্ন হল, কী দরকার? —এই চুপ।
গর্জন বন্ধ করে শান্ত হয়ে দাঁড়াল কুকুরটা। মেয়েটির মুখের দিকে মুখ তুলে প্রসাদাকাক্ষীর মতো লুব্ধভাবে লেজ নাড়তে লাগল।
ভীত শুকনো গলায় বললুম, রায়বাহাদুর আছেন?
বাবা? হ্যাঁ আছেন বই কী।
একটু দেখা করা সম্ভব হবে?
আসুন।
লোহার ফটক খুলে গেল। অ্যাসফল্টের রাস্তায় এবার বিস্তৃত আমন্ত্রণ। উজ্জ্বল মসৃণ পথ —আমার তালি-দেওয়া জুতোটার চাইতে অনেক পরিষ্কার।
সবুজ পর্দা সরিয়ে ভেতরের কার্পেটে পা দিলাম। নীলরঙের একটু স্নিগ্ধ আলোয় ঘরটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সেটির ওপর পা তুলে আধশোয়া অবস্থায় এক ভদ্রলোক কী পড়ছিলেন। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই উঠে বসলেন।
নমস্কার-প্রতিনমস্কারের পালা শেষ হল। ভদ্রলোক বললেন, বসুন। কী দরকার?
স্পন্দিত বুকে পরিচয়পত্রখানা বাড়িয়ে দিয়ে আসন নিলাম।
রায়বাহাদুর খামখানা খুলে মনোনিবেশ করলেন চিঠিতে, আর আমি মাঝে মাঝে ভীরু দৃষ্টিতে তাঁকে লক্ষ করতে লাগলাম। ভারী গোল একখানা মুখ, টকটকে ফর্সা ত্বকের ভেতর দিয়ে যেন রক্তকণিকা বাইরে ফুটে বেরিয়ে পড়ছে। ব্লাড প্রেশার কথাটার ডাক্তারি সংজ্ঞা জানি না, কিন্তু কথাটার বাংলা অর্থ যদি রক্তাধিক্য হয় তা হলে ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ব্লাড প্রেশারে ভুগছেন।
নিঃশব্দ কয়েকটি মুহূর্ত। কোথায় একটি ঘড়ি টিক টিক করছে। হাওয়ায় উড়ছে রায়বাহাদুরের কিমানোর হাতাটা। বাঁ-হাতের অনামিকায় অমন জ্বলজ্বল করছে কী ওটা? হিরাই নিশ্চয়।
চিঠি পড়া শেষ করে রায়বাহাদুর আমার মুখের দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টি শান্ত আর উদার। অবচেতন মন থেকে কেমন একটা আশ্বাস যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, হয়তো হয়েও যেতে পারে চাকরিটা।
প্রমথর ছেলে তুমি? আরে তাহলে তো তুমি আমার নিজের লোক। তোমার বাবা আর আমি—ফরিদপুরে ঈশান ইশকুলে একসঙ্গেই পড়েছিলাম। প্রমথ, ওঃ! হি ওয়াজ এ নাইস বয়!
আমি বিনয়ে মাথা নত করে রইলাম।
তোমার বাবা যখন রেজিগনেশন দেয়, সে-খবর আমি পেয়েছিলাম। ছোটোবেলা থেকেই ও খুব স্পিরিটেড, অন্যায় কখনো সইতে পারত না। নইলে এত সহজে অমন চাকরি ছেড়ে দিলে! অ্যান একসেপশনাল বয় হি ওয়াজ।