আবার বিদ্যুতের চমক আর মেঘের ডাক। আর নদীর এপারে এবার যা আমরা দেখতে পেলুম, তাতে আমাদের চোখ সোজা কপালে উঠে গেল। ভাঙা কলসি, কয়লা ছাই আর কয়েকটা আধপোড়া বাঁশ। একটা দড়ির খাঁটিয়া তাদের মাঝখানে আকাশে চার পা তুলে উটে পড়ে আছে।
আমি বললুম, শ্মশান।
ওপারের নিবিড় জঙ্গল থেকে হু-উ-উ করে একটা শেয়াল ডেকে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে এপারে ওপারে ডাইনে বাঁয়ে–আন্দাজ শখানেক শেয়াল একসঙ্গে সাড়া তুলল–হুঁয়াহুয়া–কেইসা হুয়া?
যেন আমাদের ঠাট্টা করছে।
-ওরে বাবা রে—
যে-পথ দিয়ে এসেছিল, সেই পথ দিয়েই নিতাই প্রাণপণে ছুট লাগাল–আমরাও তার পেছনে পেছনে। আর চারদিক থেকে শেয়ালেরা সমস্বরে বলতে লাগল : মজা হুয়া-আচ্ছা হুয়াহুয়াহুয়া।
এর মধ্যে আবার ঝমাঝম করে বৃষ্টি নামল।
গর্তে পা পড়ে নিতাই ধপাৎ করে একটা আছাড় খেল, তার ওপর উবুড় হয়ে পড়ল নেপাল এবং সেই সঙ্গে আমাকেও টেনে নামাল। পাঁচ মিনিট জলে কাদায় জড়াজড়ি করে যখন আমরা দাঁড়ালুম, তখন নিতাইয়ের সিল্কের পাঞ্জাবির আধখানা আমার হাতে আর আমার শাদা জুতোটার একটা কোথাও খুঁজে পেলুম না।
কিন্তু উঠে দাঁড়িয়েই নিতাই আবার বসে পড়ল।
কী হল রে?
–পা মচকে গেছে হাঁটতে পারছি না আর। ওফ! বৃষ্টিটা যেমন হঠাৎ এসেছিল–তেমনি ছেড়ে গেল। মাঝখান থেকে আমাদের দুঃখের বোঝাটা বাড়িয়ে গেল খানিকটা। আর আমরা সেই জঙ্গলের ভেতরে, জলকাদায় বসে পনেরো মিনিট ধরে নিতাইয়ের পা দলাই-মলাই করতে লাগলুম।
নিতাই শেষ পর্যন্ত আমাদের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে পড়ল। তারপর হাঁটতে লাগল নেংচে নেংচে।
–এই ন্যাপলাটার বুদ্ধিতে পড়েই
নেপাল ফোঁস করে উঠল : আমি কী করব? সেই ভদ্রলোক যেমন বলেছিলেন
ভদ্রলোক!–নিতাই বিকট রকম মুখ ভ্যাংচাল : একটা মিথ্যেবাদী–লায়ার–জোচ্চোর–।
আরও কী সব গাল দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কোত্থেকে তিন চারটে টর্চের আলো পড়ল আমাদের গায়ে। দেখি আট-দশজন লোক হাতে তাদের লাঠি আর বল্লম। কী সর্বনাশ-ডাকাত নাকি?
কারা আপনারা!কড়া গলায় কে জানতে চাইল।
আমরা–আমরা বিদেশী লোক!–আমি হাউমাউ করে বললুম : আমরা বরযাত্রী কলকাতা থেকে আসছি হরিশপুর কদমতলায় যাব। আমাদের
বরযাত্রী! হরিশপুর কদমতলা-লোকগুলো একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল : তা বেশ–গল্পটা শুনতে ভালোই। চলুন–আপনাদের অভ্যর্থনা করতেই আমরা এসেছি। বিয়েবাড়িতেই নিয়ে যাব।
তার মানে?–অভ্যর্থনাটা ঠিক সুবিধেমতো মনে হল না।
–আমরা গ্রামের ডিফেন্স পার্টি। তিনজন বিদেশী লোক এই দুর্যোগের রাতে শ্মশানের জঙ্গলে কেন ঘুরছিলেন তার একটা ভালো কৈফিয়ৎ দিতে হবে। থানায় চলুন
–থানা!-নেপাল হাহাকার করে উঠল :বরযাত্রীকে থানায় নেবেন মানে?
কারণ, থানাই তাদের জায়গা। আর একটাও কথা নয়, চলুন।
অগত্যা থানাতেই টেনে নিয়ে গেল।
খরিশপুরের দারোগা আমাদের কাহিনী শুনে হেসে অস্থির।
–আহা, হরিশপুর কদমতলার বরযাত্রী না হলে পাঁচ মাইল উজিয়ে খরিশপুরে কেন আসবে? হরিশপুর স্টেশনের পাশেই কদমতলা–সে সব ফেলে খরিশপুরের শ্মশানে না গেলে বরযাত্রী কিসের?–তারপর চোখ কটমট করে বললেন, ছোরা-বোমা–সিঁদকাঠি এ-সব কোথায়?
–খবরদার, ভদ্রলোককে অপমান করবেন না। আমরা প্রতিবাদ করলুম।
ভদ্রলোক!-দারোগা নাকটা শিকেয় তুললেন : এরকম কজন ভদ্রলোককে তিন মাস আগেই চুরির দায়ে আমরা চালান করেছি। তাদের জেল হয়ে গেছে। তোমরাও থাকো আজ হাজতে। কাল সকালে তোমাদের ওস্তাদি আমি দেখে নেব।
দয়া করে যদি হরিশপুর জগদীশ চক্রবর্তীর বাড়িতে একটা খবর পাঠান
–দেখা যাবে কাল বলে দারোগা সোজা আমাদের হাজতে চালান করলেন। সারারাত ভিজে কাপড়-জামায়, খিদেয় লজ্জায় আর ভয়ে আমাদের কী ভাবে যে কাটল, তা বোধহয় না বললেও চলে। নিতাই একটা কুটকুটে কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকল, নেপাল দুহাতে মুখ ঢেকে কুঁইকুঁই করে একটানা কেঁদে চলল আর আমি সারা রাত ধরে অন্তত হাজার খানেক মশা মারলুম।
সকালে উঠে তিনজনে জড়াজড়ি করে বসে আছি আর ভাবছি, এর পরে কপালে কী আছে–এমন সময়–হাজতের দরজা খুলে দারোগা, বিষ্টুপদ আর
আর সেই ভদ্রলোক! সেই মুখুজ্যে মশাই–সেই গোলগাল লোকটি, পাকা আমের মতো চেহারা, কাঁচা-পাকা গোঁফ যিনি আমাদের হরিশপুর কদমতলার সোজা রাস্তাটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
আমরা তিনজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম : এই যে জোচ্চোর মিথ্যাবাদী—পাষণ্ড–ভণ্ড
বিষ্টুপদ বললে, আরে, কাকে কী বলছিস! উনি যে আমার খুড়শ্বশুর হন সম্পর্কে। সকালে চৌকিদার গিয়ে খবর দিতে–উনিই তো আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলেন! আর তোদের চেহারার বর্ণনা দিয়ে বললেন, এই রকম তিনজন লোক কাল সন্ধের ট্রেনে বলাবলি করছিল, তারা হরিশপুরে বরযাত্রী যাচ্ছে। আর তাতেই তো আঁচ করলুম, তোরা ভুল করে
আমরা আবার চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলুম–ভদ্রলোক একগাল হাসলেন। একেবারে নির্লিপ্ত অহিংস হাসি।
বরযাত্রীদের নিয়ে একটু রসিকতা করেছিলুম মশাই, তারপর উল্টো ট্রেনটায় হরিশপুরে চলে এসেছিলুম। ভেবেছিলুম, একটু বাদে আপনারাও এসে যাবেন। কিন্তু এভাবে হাজতবাস করতে হবে সেটা ভাবিনি। এখন দয়া করে হরিশপুরে চলুন, চা-জলখাবার–গরম পোলাও-মাংস সব তৈরি।
কিন্তু সে-মাংস-পোলাওয়ের আকর্ষণে আমরা আর হরিশপুরে যাইনি। সোজা কলকাতায় ফিরে এসেছিলুম। আর হরিশপুরে বিয়ে করার জন্যে বিষ্টুপদর সঙ্গে আমাদের চিরকালের মতোই বন্ধু-বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। ওকেও কি বিশ্বাস আছে আর? সেই কালান্তক শ্বশুরবাড়ি থেকে কোন্ মারাত্মক রসিকতা আমদানি করে আমাদের একদম ফাঁসিয়ে দেবে কে জানে!
হাঁড়
লোহার ফটকের ওপারে দুটো করালদর্শন কুকুর। যে-দৃষ্টিতে তারা আমার দিকে তাকাচ্ছিল সেটা বন্ধুত্ববাচক নয়। এক-পা এগিয়ে আবার তিন-পা পেছিয়ে গেলাম।