বেশ তো, বেশ তো!–আমরা দারুণ খুশি হলুম।
ট্রেন হরিশপুরে এল, দুমিনিট পরে ছেড়েও গেল। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল বাঁ-দিকে একটা বাড়ির সামনে মস্ত চাঁদোয়া খাটানো, পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে, বিস্তর লোক আনাগোনা করছে সেখানে।
নেপাল ছটফট করে উঠল।
–ওই তো একটা বিয়েবাড়ি ওখানে।
ভদ্রলোক আর-এক টিপ নস্যি নিলেন। হেসে বললেন, ও অন্য বিয়ে। এখন তো মরশুম মশাই–চারদিকেই বিয়ে হচ্ছে।
–তা বটে, তা বটে!–নিতাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল–যা খিদে পাচ্ছে, ওখানে গিয়ে পাতা নিয়ে বসে পড়লেও হত।
ভদ্রলোক বললেন, তা মন্দ নয়। আমিও একবার ভুল করে আর-এক বিয়ে বাড়িতে চলে গিয়েছিলুম। সে যা কাণ্ড! বলে বেশ একটা মজার গল্প জুড়ে দিলেন। দেখলুম, লোকটি ভারি রসিক।
আমরা প্রাণ খুলে হাসছি, এমন সময় ঘটাং ঘটাং করে গাড়ি খরিশপুরে পৌঁছে গেল। হাঁড়ি দুটো তুলে নিয়ে ভদ্রলোক বলেন, নামুন–নামুন! গাড়ি এখানে এক মিনিটের বেশি দাঁড়ায় না।
আমরা চটপট নেমে পড়লুম।
ছোট্ট স্টেশন। ঘন হয়ে অন্ধকার নেমেছে ঝিঁঝি ডাকছে ঝাঁ ঝাঁ করে। দূরে কাছে কয়েকটা মিটমিটে আলো–স্টেশনের পাশেই গোটা দুই দোকান দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন, স্টেশন থেকে বেরিয়েই দুটো পিপুলগাছের তলা দিয়ে যে রাস্তাটা বাঁ-দিকে গেছে-তাই ধরে এগোবেন। খানিক দূর গেলেই একটু জংলা মনে হবে পথটা-তাতে ঘাবড়ে যাবেন না। তারপরেই একটা ছোট নালা বাঁশের পুল রয়েছে–সেটা পেরুলেই
স্টেশনমাস্টার টিকিটের জন্যে এগিয়ে এলেন। তারপর ভদ্রলোককে দেখে একগাল হেসে অভ্যর্থনা করলেন।
-মুখুজ্যেমশাই আজ এখানে যে?
হুঁ একটু কাজে আসতে হল। শুনুন, এঁরা তিনজন কলকাতা থেকে আসছেন, খরিশপুরের বদলে ভুলে হরিশপুরের টিকিট কেটেছেন। বাড়তি কিছু দিতে হবে নাকি?
–ঠিক আছে–ঠিক আছে-রেল স্টেশনমাস্টার আমাদের টিকিট নিয়ে চলে গেলেন। আমরা মুখুজ্যেমশায়ের ওপর আরও খানিকটা কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলুম।
নিতাই জিজ্ঞেস করলে, আপনি কোথায় যাবেন?
-আমি? আমিও যাব ওই দিকটাতেই। তবে একটু দেরি হবে আমার। দশ-বারো মিনিটের ভেতরেই উল্টো দিকের একটা গাড়ি আসছে। তাতে আমার এক বন্ধুর আসবার কথা। সে-ও এদিকে নতুন লোক, একেবারে তাকে সঙ্গে নিয়েই যাব। কিন্তু আপনারা আর দেরি করবেন না-এগোন।
না, দেরি করা চলবে না, পেটে আগুন জ্বলছে-নেপাল আগেভাগেই পা বাড়াল। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ আর নমস্কার জানিয়ে আমরা দুজনেই নেপালের পেছনে চলতে শুরু করে দিলুম।
ভদ্রলোক ডেকে বললেন, কিছু অসুবিধে হবে না–এগিয়ে যান
–আচ্ছা–আচ্ছা
পিপুলগাছটার তলা দিয়ে বাঁয়ের রাস্তায় আমরা চলতে শুরু করলুম। দু-ধারে ছোট বড় কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ল বটে, কিন্তু কোনওটাকেই বিয়েবাড়ি বলে মনে হল না। খিদের তাড়ায় হনহন করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। মাটির পথ-অন্ধকারে একটু অসুবিধেও হচ্ছিল। কিন্তু আধ মাইলের তো ঝামেলা–দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাব।
কিন্তু কোথায় সেই আধ মাইল?
একটু পরেই দুপাশে শুরু হয়ে গেল ঘন জঙ্গল। এত অন্ধকার যে, চোখ আর চলতে চায়। চারপাশে খালি অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে আর মাথার ওপর ঘনিয়ে এসেছে নিবিড় কালো মেঘ। আমি একবার পা পিছলে পড়তে পড়তে সামলে নিলুম-নিতাই একটা হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
–এই ন্যাপলা ব্যাপারটা কী বল তো? এ কীরকম বিয়েবাড়ির রাস্তা? নেপাল মোটা মানুষ হলে কী হয়–খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সে চিরকালই অত্যন্ত উৎসাহিত আর দারুণ রকম তৎপর।
নেপাল বলে, দাঁড়াসনি, চল–চল। মোটে তো আধমাইল যেতে হবে।
–আধ মাইল! আধ মাইল কাকে বলে আমি জানিনে?–নিতাই চটে গেল : সেই তখন থেকে হাঁটছি বাড়ি নেই, ঘর নেই–কেবল শাঁ শাঁ করছে অন্ধকার জঙ্গল–যেন আফ্রিকার বনের ভেতর দিয়ে চলেছি। নিশ্চয় রাস্তা ভুল হয়েছে।
নেপাল বললে, রাস্তা ভুল হবে কেন? ভদ্রলোক যেভাবে বলে দিয়েছেন–সেই ডিরেকশনেই তো চলেছি। আর কোনও রাস্তা তো এদিকে দেখিনি।
নিতাই গোঁ গোঁ করে বললে, দুত্তোর ডিরেকশন! যা জঙ্গল চারদিকে বিয়ে বাড়িতে ভোজ খাওয়ার আগে বাঘেই আমাদের ভোজে লাগাবে মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, পাড়াগাঁয়ের রাস্তা একটু জংলা হয়ই। আর একটু এগিয়ে দেখা যাক না। কিন্তু বেশি দূর এগোতে হল না। হঠাৎ রাস্তাটা শেষ হয়ে গেল। তারপরেই দেখা গেল, ঢালু পাড়ির নীচে খানিকটা জলের রেখা। আর একধারে ভূতুড়ে চেহারা নিয়ে একটা বাঁশের পুল দাঁড়িয়ে।
নেপাল খুশি হয়ে বললে, ব্যস–এই তো এসে গেছি। এই সেই নালা, আর এই পুলটা পেরোলেই
নিতাই বললে, নালা? এ তো দস্তুরমতো নদী দেখছি।
আরে এসব দেশে নদীটাকেই নালা বলে। পাড়াগাঁয়ে তোক তো! চল, চল, খিদেয় দাঁড়াতে পারছি না।
নেপাল বাঁশের পুলটার দিকে পা বাড়াল।
আর ঠিক তক্ষুনি চারদিক ঝলসে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকাল-কড়কড় করে ডেকে উঠল মেঘ। সেই বিদ্যুতের আলোয় সব স্পষ্ট দেখতে পেলুম আমরা। নীচে ছোট একটা নদীই বটে। বাঁশের পুলটা তার আধখানা পর্যন্ত গিয়ে ভেঙে পড়েছে। অন্তত পাঁচ বছরের ভেতর তার ওপর দিয়ে কেউ পার হয়নি। আমরা সেই পুলে উঠে একটু এগোলেই সোজা নদীতে গিয়ে পড়তুম। ওপারে অথই জঙ্গল–যেটুকু দেখতে পেলুম তাতে মনে হল শুধু বাঘ কেন, ওখানে হাতি, গণ্ডার, ভালুক–অজগর সব কিছু থাকা সম্ভব।