আমাদের সেই বিষ্টুপদর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল হরিশপুরে।
তখন হরিশপুরের মহিমা কে জানত! আমরা তিন বন্ধুই খুশি হয়ে উঠলুম।
বিষ্টুপদ বললে, আমার বিয়েতে তোরা যাবি তো?
আমি, নিতাই আর নেপাল একসঙ্গে বললুম, নিশ্চয় নিশ্চয়! আমরা বরযাত্রী না গেলে তোর তো ভালো করেই বিয়েই হবে না!
কিন্তু বিয়ের দিন বিষ্টুপদর সঙ্গে বেরুনো গেল না। সরকারি অফিস–তায় অসম্ভব কাজের চাপ পড়েছে। বন্ধুর বিয়ের জন্যে ছুটি চাইতে গেলে পুরো একটা দিনের মাইনেই কেটে নেবে। তাই বরকে নিয়ে আসল দলটা দুপুরের দিকে রওনা হয়ে গেল–আমরা ঠিক করলুম অফিস ছুটি হলে সওয়া পাঁচটার ট্রেনেই বেরিয়ে পড়ব।
অবিশ্যি তাতে কোনও অসুবিধে ছিল না। হরিশপুর কলকাতা থেকে খুব দূরে নয়। ছোট লাইনের যেসব গাড়ি ঝিমুতে ঝিমুতে টিকিস টিকিস করে চলে তারাও ঘণ্টা দেড়েকের ভেতরেই হরিশপুর পৌঁছে যায়। আমরা হিসেব করে দেখেছিলুম, বিকেলের গাড়িতে গেলেও সন্ধে সাতটার ভেতরে বিয়ে শুরু হওয়ার আগেই হরিশপুরে হাজির হতে পারব।
চারটে বাজতে না বাজতেই আমরা অফিস থেকে ছিটকে বেরুলুম। বন্ধুর বিয়ের বরযাত্রী যাচ্ছি, একটু সাজগোজ না হলেই বা চলে কী করে। আমি প্রাণপণে একটা শাদা জুতোকে রং করলুম, নেপাল তার খাড়া-খাড়া চুলগুলো আধঘণ্টা ধরে বাগাতে চেষ্টা করলে আর নিতাই নিজের পুরনো সিল্কের পাঞ্জাবিতে প্রায় এক শিশি সেন্ট ঢালল।
তারপর হাওড়ায় এসে ট্রেন ধরা।
প্রথমদিকে খুব ভিড় ছিল গাড়িতে। কেএকজন আমার শাদা জুতোটাকে মাড়িয়ে দিলে, নেপালের সিল্কের পাঞ্জাবিটার ভাঁজ-টাঁজ নষ্ট হয়ে গেল, একজন আবার নিতাইকে ঠাট্টা করে বললে, দাদা যেন গন্ধমাদন হয়ে চলেছেন। যাই হোক, হরিশপুরের গোটা তিনেক স্টেশন আগে গাড়িটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল, তখন আমরা তিনজনে ভালো করে বসতে পেলুম।
নিতাই বললে, এতক্ষণে একটু ভালো করে বসা গেলবাব্বাঃ! আমি বললুম, কতটুকুই বা বসা–এক্ষুনি তো নামতে হবে। নিতাই একটা হাই তুলে পাঞ্জাবিটা একবার শুকে নিলে। তারপর খুশি হয়ে বললে, নামলেই বাঁচি। যা খিদে পেয়েছে ভাই-কী বলব!
নেপাল নিজের খাড়া-খাড়া চুলে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললে, খিদে তো আমারও পেয়েছে। আমি যেন এখান থেকেই লুচিভাজার গন্ধ পাচ্ছি।
আমি বললাম, আমার নাকে মাংসের কালিয়ার গন্ধ আসছে।
নিতাই ভাবুক হয়ে উঠল। বেশ উদাস-উদাসচোখ করে বলে চলল, আর আমি পষ্ট দেখতে পাচ্ছি রাশি রাশি চপ ভাজা হচ্ছে বড়বড় থালায় সাজিয়ে রাখা হচ্ছে ভেটকির ফ্রাই
আমি আর নেপাল বললুম, আহা-আহা! আর বলিসনি।
আমাদের তোমরা পেটুক ভাবছ নিশ্চয়। কিন্তু আমরা কী করব বলল! তিনজনেই মেসে থাকি। বিউলির ডাল, পুঁই চচ্চড়ি আর শুকনো পোনামাছের টুকরো খেতে খেতে পেটে প্রায় চড়া পড়ে গেছে। তাই কিঞ্চিৎ খ্যাঁটের আশায় আমরা বেশ খানিকটা উত্তেজনা বোধ করছিলাম।
ঠিক সেই সময় বুড়ো ভদ্রলোকটি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন আপনারা?
কামরাতে আমরা তিনজন ছাড়া এই ভদ্রলোক হলেন চার নম্বরের যাত্রী। বেশ পাকা আমটির মতো ফরসা গোলগাল চেহারা, মুখে একজোড়া মানানসই কাঁচা-পাকা গোঁফ, মাথায় চকচকে টাক, দেখলেই ভক্তি আসে। সঙ্গে দুটি বিরাট সাইজের মুখ বাঁধা হাঁড়ি।
এতক্ষণ এক কোণায় বসে আমাদের লক্ষ্য করছিলেন। এইবারে প্রশ্ন ছুঁড়লেন।
-কোথায় যাবেন?
আমরা এক সঙ্গেই বললুম, হরিশপুর।
বরযাত্রী বুঝি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ
।–বেশ, বেশ। হরিশপুর কদমতলায় জগদীশ চক্কোত্তির মেয়ের বিয়েয় যাচ্ছেন–তাই না?
আমরা অবাক হলুম একটু। নিতাই জিজ্ঞেস করলে, কী করে জানলেন?
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, আমরা এ-তল্লাটের লোক–সব রকম খবরই রাখি। ছেলেটির নাম বিষ্টুপদ গোস্বামী নয় কি?
নেপাল চোখ কপালে তুলে বললে, তা-ও জানেন দেখছি।
ভদ্রলোক গোঁফজোড়ায় বেশ একবার তা দিয়ে নিলেন। তারপর তেমনি শান্ত হাসি হেসে বললেন, বললুম যে আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক সব খবরই রাখতে হয়। এ তো আর কী বলে আপনাদের কলকাতার ব্যাপার নয় যে দোতলায় বিয়ে হলে একতলার লোককে নেমতন্ন করে না।
ট্রেন তখন আর একটা স্টেশন পার হয়েছে। এর পরেই হরিশপুর। ভদ্রলোক বেশ করে এক টিপ নস্যি নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, তা নামবেন কোন স্টেশনে? খরিশপুরেই তো?
আমি বললুম, খরিশপুরে কেন? আমরা তো হরিশপুরে যাব।
–জানি–জানি। হরিশপুর কদমতলায়। সে তো খরিশপুর থেকেই কাছে হয়।
বলেন কী! হরিশপুরের কদমতলা খরিশপুরে যেতে যাবে কেন?
হাতের নস্যি ঝাড়তে ঝাড়তে ভদ্রলোক বললেন, হুঁ, এদিকে নতুন লোক কেউ এলে ওই ভুলটাই করে। নামে হরিশপুর কদমতলা হলে কী হয় হরিশপুর স্টেশন থেকে পাকা দুমাইল হাঁটতে হয়। আর খরিশপুর থেকে আধ মাইলও হবে না। মিথ্যে হরিশপুরে নেমে কষ্ট পাবেন কেন?
নিতাই আপত্তি করল কই, আমাদের তো কেউ সেকথা বলে দেয়নি।
বললুম তো, বাইরের লোক সবাই-ই ভুল করে। তা ইচ্ছে হলে আপনারা হরিশপুরেই নামতে পারেন–আমার তাতে কী বলবার আছে, বলুন।
নেপাল বললে, তা হলে বরং খরিশপুরেই নামব আমরা। যা খিদে পেয়েছে–এখন দু মাইল হাঁটতে গেলে পেটের নাড়িভুড়ি সব হজম হয়ে যাবে! কিন্তু খরিশপুর আবার কোথায়?
–বেশি দূর নয়–খরিশপুরের পরের স্টেশন। ভদ্রলোক হাসলেন–চলুন, আমিও খরিশপুরেই যাচ্ছি। রাস্তাটা দেখিয়ে দেব আপনাদের।