–সে কী করে হয়? রিজার্ভ-গাড়ি তো নয়। পথে অন্য প্যাসেঞ্জার এসে ধাক্কাধাক্কি করবে।
করুক না। করে করে হয়রান হয়ে অন্য গাড়িতে গিয়ে উঠবে। জায়গার তো অভাব নেই।
খুব মন দিয়ে দরজা-জানলাগুলো বন্ধ করতে লেগে গেলেন। ওঁর বুট-পরা পায়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার রোমাঞ্চ হতে লাগল।
ফিরে এসে গেলেন নিজের বেঞ্চিতে। হাসলেন আত্মপ্রসাদের হাসি।
এবার নিশ্চিন্দি। কী বলেন?
আমি বললাম, যেরকম দুর্দান্ত চোরের গল্প বলছেন, কিছুতেই কি নিশ্চিন্ত হওয়ার জো আছে?
–তা যা বলেছেন! এ লালগোলা লাইনের চোর, সিগারেটে একটা টান দিয়ে আবার ঝিমন্ত বকের মতো খানিকটা চিন্তা করলেন ভদ্রলোক : ভালো মনে করিয়ে দিয়েছেন।
আবার উঠলেন : বাথরুমটা ম্যানেজ করা যাক।
বাথরুম?
হুঁ। ওটাও ওদের চলাচলের একটা রাস্তা কিনা–দিব্যি তলাটি খুলে আসেন, তারপর সেই পথেই আবার অন্তর্ধান। দেখেছেন? পকেট থেকে জড়ানো সুতোর দড়ি বের করলেন খানিকটা।
ওটা আবার কী?
–অ্যামেরিকান কর্ড। ডিসপোজালের জিনিস। হাতি পর্যন্ত বাঁধা যায় মশাই।
–ওটা দিয়ে কী করবেন?
–মেঝের বেঞ্চির সঙ্গে আর ওর লকের সঙ্গে বেঁধে রাখব। যদি কখনও যেতে চান, ফাঁসটা খুলে চলে যাবেন। কিন্তু ওর ভেতর থেকে কেউ যদি হাজার টানাটানিও করে, তা হলে খুলতে হচ্ছে না তাঁকে। স্যান্ডো কিংবা ভীম ভবানী হলেও না।
এবার আমি দস্তুরমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
সবরকম ব্যবস্থাই তো আপনার সঙ্গে দেখছি।
–কী করব, বলুন।–লকের সঙ্গে অ্যামেরিকান কর্ড বাঁধতে বাঁধতে বললেন : নেসেসিটি ইজ দি মাদার অব ইনভেনশন। জানেন তো! আজ আনতে ভুলে গেছি, আমার সঙ্গে ব্যাঙবাজনা পর্যন্ত থাকে।
ব্যাঙ-বাজনা? সে আবার কী?
–দেখেননি? ওই যে মাটির খুরির ওপরে পাতলা চামড়া দেওয়া, তার ওপরে দুটো কাঠি? দড়ি ধরে টানলেই প্যাং প্যাং করে বাজতে থাকে? মানে, ছেলেপুলেরা রাস্তা দিয়ে টানে।
বুঝেছি। কিন্তু কী হয় ও দিয়ে?
বড় সুটকেস-টুটকেস থাকলে–মানে যা মাথায় দিয়ে শোওয়া যায় না তার সঙ্গে বেঁধে রাখি। কেউ ধরে টান দিয়েছে কি ট্যাং ট্যাং করে সাড়া দিয়ে উঠবে। একবার চিংড়ি মাছ দিয়ে ঘন্ট খাব বলে দেশ থেকে এক মস্ত লাউ নিয়ে যাচ্ছিলাম কলকাতায়। মাঝরাতে সেই লাউ ধরে চোরে টান দিয়েছে। ভাগ্যিস ব্যাঙ বাজনা বাঁধা ছিল, ব্যস টের পেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। আর চোরও তেমনি। যেন ইনভিজিবল ম্যান–সঙ্গে সঙ্গে গন উইথ দি উইণ্ড! দড়ি বাঁধা শেষ হল। ফিরে এসে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। সেই বুটসুদ্ধই।
-শোবেন না?
বললাম, না।
–জেগে-জেগে পাহারা দেবেন নাকি?–ভদ্রলোক হাসলেন!
–ঠিক পাহারা দেওয়া নয়,–মানে এখনও আমার ঘুম পায়নি।
তবে বসে থাকুন। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। কাল কলকাতায় পৌঁছেই আবার একরাশ কাজ।
–ভদ্রলোক একটা হাই তুললেন, মুখের কাছে তুড়ি বাজালেন। তারপর সোজা চিত হয়ে পড়লেন। ডিটেকটিভ বইটা পড়তে-পড়তে মাঝে মাঝে আমি শুনতে লাগলাম ব্যাঙ বাজনা বাজছে। মানে, নাক ডাকছে ওঁর।
আমি একটার পর একটা অধ্যায়ের রহস্যের মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু নাক ডাকা জিনিসটা ছোঁয়াচে। ওঁর মুখটা বার বার খুলে বন্ধ হতে লাগল, আর শব্দ উঠতে লাগল ফোঁ—ফর-র—ফোঁ—ফর–র
আমি কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম সেদিকে। তারপর হিংসে হতে লাগল, তারও পরে মনে হতে লাগল, সব ব্যবস্থাই যখন উনি পাকা করেই রেখেছেন, তখন আমিও আর–জুতোটা একেবারে অন্ধকার তলার দিকে ঠেলে দিয়ে লম্বমান হয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দুটো জিনিস আবিষ্কার করলাম। প্রথমত ভদ্রলোক অদৃশ্য হয়েছেন– আমার সুটকেস, পুরনো জুতোজোড়া, এমনকি অ্যামেরিকান কর্ড পর্যন্ত কিছুই বাদ যায়নি। আর দ্বিতীয়ত–সেইটেই সবচেয়ে বিস্ময়কর!
যাওয়ার আগে, আমার অবিশ্বাস ভাঙবার জন্যেই কিনা কে জানে, ফেলে গেছেন নিজের ছোট অ্যাটাচিটা। সেইটে খুলে দেখলাম : আর কিছু নেই–একখানা চকচকে ক্ষুর। এখন আর আমার বিশ্বাস করতে বাধা নেই–এই ক্ষুরেই জঙ্গিপুরের সেই ভদ্রলোকের দাড়ি নিশ্চিহ্ন আর নিরুদ্দেশ হয়েছে।
লালগোলা লাইনের শ্রেষ্ঠ গুণীর সঙ্গে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে দেখা হয়েছে, আপাতত এইটেই আমার সান্ত্বনা।
হরিশপুরের রসিকতা
পৃথিবীর সব লোককেই বিশ্বাস করতে পারো, কিন্তু হরিশপুরের লোককে কখনও বিশ্বাস কোরো না। ভুলেও নয়।
না না–চুরি জোচ্চুরির ভিতরে তারা নেই। তারা কাউকে ঠকায় না। এই কলকাতা শহরে একজন পকেটমারও হরিশপুরের লোক নয়–একথাও আমি হলফ করে বলতে পারি। তারা কেউ বদমেজাজী নয়–গায়ে পড়ে কখনও ঝগড়া করে না। তাদের মিঠাইয়ের দোকানে তিনদিনের পচা সিঙাড়াকে কখনও হাতে গরম বলে চালিয়েও দেয় না। আসল কথা হল
কথাটা আর কিছু নয়। হরিশপুরের মানুষ একটু রসিক। খানিকটা বেশি মাত্রাতেই রসিক।
কী বলছ? রসিক মানুষকে তো ভালোই লাগে? হুঁ, আমারও লাগত একসময়। কিন্তু সেবার সেই বরযাত্রী যাওয়ার পর–আচ্ছা, খুলেই বলছি তা হলে।
আমরা চারজন একই অফিসে চাকরি করি। আমি, নিতাই, নেপাল আর বিষ্টুপদ। দারুণ বন্ধুত্ব আমাদের ভেতরে। একসঙ্গে পকৌড়ি কিনে খাই, সিনেমার টিকিট কিনি, মোহনবাগানের খেলা দেখতে যাই, মোহনবাগান জিতলে চারজনের ছাতা-জুতো হারিয়ে যায় আর মোহনবাগান গোল খেলে গলা জড়াজড়ি করে কাঁদতে বসি।