মোহিনীর অস্বস্তি লাগতে লাগল, অতি তীব্র অস্বস্তিতে জ্বালা করতে লাগল সমস্ত শরীরটা। এখানে সে অনধিকারী, তার উপস্থিতিতে যেন এখানকার উচ্ছ্বসিত আনন্দের মধ্যে ছন্দপতন ঘটে যাচ্ছে। এখান থেকে এখন তার সরে যাওয়াই উচিত। মোহিনী হাতঘড়িটার দিকে। তাকাল। রাত নটা বাজে। অফিসের কাগজপত্র এলোমেলো, গুদামের বাড়তি তিনশো বস্তা রিমুভ করবার কোনো বন্দোবস্ত এখনও হয়নি। ওদিকে কাল সন্ধ্যার ট্রেনেই শঙ্করলাল এসে পড়বে। বোম্বাইয়ের পাকা ব্যাবসাদার লোক, আর যা-ই চলুক, ফাঁকি চলবে না।
মোহিনী উঠে দাঁড়াল। এক্সকিউজ মি, অফিসে জরুরি কাজ পড়ে আছে, আমাকে এখুনি উঠতে হবে।
দ্য স্কাউন্ট্রেল সিরকার ইজ অলওয়েজ বিজি।
লেট হিম গো।
উই হ্যাভ গট আওয়ার বিউটি। পাঞ্জাবি জিভ কাটলে, আওয়ার সুইট হোস্টেস।
মুখ লাল করে মোহিনী উঠে পড়ল। চা-বাগানের ম্যানেজার, ছোটোখাটো জিনিসকে গায়ে মাখলে বহুদিন আগেই এসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বানপ্রস্থ নিতে হত তাকে। কিন্তু এখানকার এই আবহাওয়া মোহিনীর পক্ষেও অসহ্য হয়ে উঠছে, নিজেকে বড়ো বেশি অপমানিত বলে বোধ হচ্ছে। আয়া আর অমলার চোখে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বহ্নিছটা, ছলনাতে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে তারই প্রতিযোগিতা চলছে যেন। মোহিনীর সৃষ্টি আজ মোহিনীকে অতিক্রম করে যাওয়ার দাবি রাখে।
জোর করেই ওখান থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলে সে, দ্রুতপায়ে বাংলোর লন পেরিয়ে চলল এগিয়ে। যা করে করুক ওরা। এখনই অফিসে গিয়ে বসতে হবে স্তুপাকার কাগজপত্র নিয়ে। কাল সন্ধ্যায় শঙ্করলাল আসবার আগেই সমস্ত ছিদ্রগুলোকে বেমালুম জুড়ে দিতে হবে।
বাংলোর বারান্দা থেকে আসছে উচ্ছসিত হাসি আর দূরে পাহাড়ের কোলে বাঘের ডাক। হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনল মোহিনী। ওই দুটো শব্দ একসঙ্গে মিলে গিয়ে যেন একটা ঐকতানের সৃষ্টির হয়েছে। ওদের মধ্যে কোথাও একটা সাদৃশ্য আছে কি?
চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সে অফিসে এসে ঢুকল। কাজ চলছে পুরোদমে। ঠেলাগাড়িতে করে বস্তাগুলো সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা ফাইল টেনে নিয়ে মোহিনী কাজের মধ্যে ডুবে গেল। ঘড়ির কাঁটায় ঘুরতে লাগল সময়।
নিস্তব্ধ রাত, প্রায় বারোটা! শুধু টেবিল-ফ্যানটা ঘুরছে কট কট করে। মোহিনী খস খস করে উলটে চলেছে ফ্ল্যাট ফাইলের শিটগুলো। হঠাৎ একটা উচ্চন্ড আর উদ্দাম চিৎকারে রাতের পৃথিবী উঠল জেগে। কুলি বস্তিতে দারুণ কোলাহল, মর্মান্তিক আর্তনাদ।
মোহিনী চমকে দাঁড়িয়ে উঠল।
কী হয়েছে? আগুন লাগল নাকি?
প্রবল চিৎকার। ভয়ার্ত কলরব। ঢন ঢন করে ঘা পড়ছে ক্যানেস্তারায়। পাঁচ-সাতটা গলার উতরোল কান্না।
একজন কেরানি বললে, আগুন নয়, নিশ্চয় কোনো জানোয়ার নেমেছে পাহাড় থেকে!
সঙ্গে সঙ্গেই দশ-বারো জন লোক খোলা দরজার পথে এসে আছড়ে পড়ল মোহিনীর পায়ে। হাউমাউ করতে করতে বললে, হুজুর বাঘ এসেছিল বস্তিতে।
বাঘ?
হ্যাঁ হুজুর। মংরুকে খাঁটিয়া থেকে তুলে নিয়ে গেল।
মোহিনীর শিরা-স্নায়ুর মধ্যে উত্তেজিত হয়ে উঠল শক্তি আর তেজের তরঙ্গ। গায়ের কোটটা ছুড়ে ফেলে দিলে চেয়ারের ওপর। বললে, যতগুলো পারিস মশাল জ্বালিয়ে দে চারদিকে। আমি বন্দুক নিয়ে আসি।
ক্ষিপ্রগতিতে মোহিনী এগিয়ে গেল বাংলোর দিকে। লোহার গেটটা এক ধাক্কায় খুলে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল বারান্দাতে। দুটো ঘরের দরজাই বন্ধ। অমলার ঘরে আলো জ্বলছে। এত রাতেও কি ঘুমোয়নি অমলা!
দরজায় ঘা দিতে গিয়েই খড়খড়ির ফাঁকে যা চোখে পড়ল তা মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ করে দিলে মোহিনীকে। অসম্ভব বা অস্বাভাবিক হয়তো নয়, কিন্তু এতখানির জন্যে সে তৈরি ছিল না। এ ঘরের মালিক এখন সে নয়, তার জায়গা দখল করেছে সিন্ধি!
রাগ নয়, দুঃখ নয়, স্ত্রীর এই রূপ দেখে উগ্র হিংস্রতার চিরন্তন প্রেরণাতেও শরীর জ্বালা করে উঠল না। মোহিনী শুধু অভিভূতের মতো তাকিয়ে রইল। কেন সে এসেছিল, কোথায় এসে সে দাঁড়িয়েছে, কয়েক মুহূর্ত কিছুই আর মনে পড়ল না। সব যেন শূন্য আর মিথ্যে হয়ে গেছে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহিনী পাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। এ ঘরও বন্ধ, ভেতর থেকে পাঞ্জাবির গলার আওয়াজ। তবে এ ঘরে আলো জ্বলছে না, অমলার চাইতে আয়ার লজ্জাটা কিছু বেশি—গৃহিণীর মতো অতটা সে এগিয়ে যেতে পারেনি। তবে তারও দিন আসছে।
নিজের ঘরেই ঢোকবার অধিকার আজ আর নেই মোহিনীর। নিঃশব্দে পা টিপে সরে এল সে, একটু জুতোর শব্দ না হয়, এতটুকু রসভঙ্গ না হয় কোনোখানে। বারান্দার রেলিং মুঠোর মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে ঝুঁকে দাঁড়াল সে। শনশন করে হাওয়া দিচ্ছে, শরীরটা মৃদু শীতের স্পর্শে উঠছে শিউরে। বাংলোর টালি-দেওয়া ছাতের ওপর টুপ টুপ করে পড়ছে রাত্রির শিশির। পাহাড়ের গায়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কালো অরণ্য। নীল-লাল আলোর দুটো সরু রেখা অন্ধকার আকাশের গায়ে বুলিয়ে বিমান উড়ে যাচ্ছে।
ওদিকে কুলি বস্তিতে কোলাহলের বিরাম নেই। অনেকগুলো মশালের আলো, ক্যানেস্তারার শব্দ, নারীকন্ঠের কান্না—মংরুর স্ত্রীই নিশ্চয়। পাহাড়ের রাজত্ব থেকে ক্ষুধার্ত বাঘ হানা দিয়েছে ওখানে। বাঘ—সোনাঝুরি বাগানের সোনালি বাঘ। যুদ্ধদেবতার কুঠার সোনায় তৈরি। কিন্তু কুঠার তো চিরদিনই কুঠার, সে শুধু হত্যাই করে।
স্বয়ং তিনিই
–এ লালগোলা লাইন মশাই, ডেঞ্জারাস চোরের জায়গা-বলতে বলতে ঢুকলে ভদ্রলোক। এক হাতে একটি ছোট অ্যাটাচি–এত ছোট যে পরামানিকের বাক্স বলে সন্দেহ হয়। আর-এক শতরঞ্জি জড়ানো একটি সংক্ষিপ্ত বিছানা।