নিজের নিজত্ব সম্বন্ধে সজাগ হবার আগেই আবার পতন, আবার উত্থান, পুনরায় পতন। কখনও পর পর তিনজন, কখনও একসঙ্গে দুজন, কখনও বা তিনজনই একসঙ্গে। পতন-অভ্যুদয়ের সে কী বিচিত্র লীলা! আঘাত খেতে খেতে এখন আর ব্যথা পাচ্ছি না–আছাড় খাওয়াটা যেন নেশার মতো ধরেছে আমাদের। কারও মুখে আর কোনও কথা নেই, পড়ছি, উঠছি আবার পড়ছি। যেন জীবনে আছাড় খাওয়াই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।
খানিক পরে পায়ের নীচে আবার শক্ত জমি পাওয়া গেল। আর মুখ খুলল ফুচুদার : উঃ–কার মুখ দেখে আজ বেরিয়েছিলাম রে! একেবারে ত্রিভুবন দেখিয়ে দিলে। আচ্ছা–এর শোধ তুলব, কই
কথাটা শেষ হল না–সঙ্গে সঙ্গে যেন ভোজবাজি। ধপাস ঝুপ করে একটা শব্দ আর ফুচুদা ভ্যানিশ।
আমি প্যালা আর মেজদা নালা–আমরা দু’ভাই নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না! সত্যিই ফুচুদা নেই, কোথাও নেই! রাস্তার পাশে একটা ছোট নালা দিয়ে বর্ষার জল যাচ্ছে–শুধু তার ওপরে একটা ছাতার বাঁট দেখা যাচ্ছে। আর স্থলে জলে অন্তরীক্ষে-উঁহু–কোথাও নেই। ফুচুদা একেবারে হাওয়া! ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি?
আমরা দুভাই প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলাম : ও ফুচুদা—
নালার জলে বিরাট আলোড়ন। ওরে বাবা, কুমির উঠছে নাকি?
না, ভয় নেই কুমির নয়, ফুচুদা উঠে এলেন। বৃষ্টির জলে যেটুকু বাকি ছিল–নালার জল তা শেষ করে দিয়েছে। গা বোঝাই পাঁক–ঘাড়ে মাথায় একরাশ পচা পাতা–নাকে মুখে ব্যাঙাচির নৃত্য–ফুচুদার সে কী রূপ খুলেছে–মরি মরি!
ফুচুদা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, একপাটি জুতো গেল। অনেক ডুবে ডুবে খুঁজলাম–ব্যাটাকে কোথাও পাওয়া গেল না। নাঃ–কপালটাই খারাপ!
তবু সব পথের শেষ আছে, আমাদেরও শেষ হল।
নেমন্তন্ন বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন আমাদের দেখে শ্যামানন্দবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, সর্বনাশ এ কী হয়েছে! এসো, কাপড়-জামা ছেড়ে ফেলো এখুনি
তোমরা ভাবছ এত দুঃখের পরে খাওয়াটা বোধহয় ভালোই জমল। কিন্তু হায় রে! তা হলে কি আর এ-গল্প লেখবার দরকার ছিল! দুগা দুর্গতি-দায়িনী কী কুক্ষণেই যে ফুচুদার প্রার্থনায় কর্ণপাত করেছিলেন। এ-যাত্রাও তিনি আমাদের ভুলবেন না।
কই মাছের গামলাটা সবে আমাদের বারান্দার দিকে আসছে আর সেদিকে তাকিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠেছে ফুচুদার চোখ, এমন সময়- আরে দূর-দূর-মার-মার-মার
শ্যামানন্দবাবু চেঁচিয়ে উঠেছেন। কিন্তু তার আগেই যা হবার তা হয়ে গেছে। কোত্থেকে একটা ঘিয়ে ভাজা কুত্তা তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে বারান্দায়।
নতুন ব্রাহ্মণ, সবে পৈতে হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাতা ছেড়ে আমরা উঠে পড়লাম। খাওয়ার পর্ব ওইখানেই ইতি।
কই মাছের গামলা আবার অন্যদিকে ফিরে গেল।
শ্যামানন্দবাবু হায় হায় করতে লাগলেন। কিন্তু ফুচুদার বুকে যে আগুন জ্বলছে তাকে নেবাবে কে?
অন্যমনস্ক চোর
তোমরা কখনও অন্যমনস্ক চোর দেখেছ? আমি একবার দেখেছিলুম। সেই কথাই বলি।
আমাদের কলকাতার বাসায় তখন কেউ নেই। গরমের ছুটি হওয়াতে সবাই দার্জিলিং বেড়াতে চলে গেছে। একশো আট ডিগ্রির জ্বালায় আমি একা বসে ছটফট করছি। অথচ আমার কলকাতা ছাড়বার জো নেই– আই এ পরীক্ষার একগাদা খাতা দেখতে হচ্ছে।
সেদিন রাতে কিছুতেই ঘুম আসছে না। একে তো প্রায় সাড়ে বারোটা অবধি খাতা দেখেছি মাথার মধ্যে বানান আর ব্যাকরণের ভুলগুলো পোকার মতো কিলবিল করছে। তায় অসহ্য গরম– ঘুরন্ত পাখাটাও যেন আগুন বৃষ্টি করছে।
অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সবে একটু ঝিমুনি এসেছে, হঠাৎ শুনতে পেলুম, ধ্যাৎ, সিন্দুকটা গেল কোথায়?
ভাবলুম স্বপ্ন দেখছি, তক্ষুনি আবার কানে এল : ড্রেসিং টেবিলটাও উড়ে গেল নাকি?
আর সন্দেহ নেই ঘরে কেউ ঢুকেছে। পুরো চোখ মেলে পরিষ্কার দেখলুম, জানালার কাছে কে দাঁড়িয়ে।
মাথার পাশেই টিপয়ের ওপরে টেবল ল্যাম্প ছিল। সুইচ টিপে সেটা জ্বাললুম। যা ভেবেছি তাই, ঘরে চোর ঢুকেছে। সাদা বেনিয়ান আর ধুতিপরা একটা বেঁটে মতো লোক– জানালার পাশটিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে। চোর চোর বলে চেঁচাতে যাব, তার আগেই লোকটা হাতজোড় করে বললে, কিছু মনে করবেন না স্যার আপনার ঘুমের ডিসটার্ব করলুম। একটু ভুল হয়ে গেছে।
লোকটার কথার ভঙ্গিতে ভয় কেটে গিয়ে ভারি আশ্চর্য লাগল আমার। বললুম, তার মানে?
সে বললে, এটা তো বাহান্ন নম্বরের বাড়ি নয়?
আমি বললুম, না– বাইশ নম্বর।
লোকটা বললে, দেখলেন তো, ঠিক ধরেছি। বাহান্ন নম্বরের জানালা বেয়ে উঠলেই ডানদিকের দেওয়ালে লোহার সিন্দুক- এই তার নকল চাবি। বলে সে আমাকে একটা ছোট চাবি দেখালে। তারপরে বলে চলল, আর লোহার সিন্দুকের পাশেই হল ড্রেসিং টেবিল- আজ রাতে গিন্নিমা সিনেমা থেকে ফিরে তার টানায় গয়নাগুলো খুলে রাখবেন। ঘরে ঢুকেই আমি টের পেয়েছি, সব গড়বড় হয়ে গেছে। ভালো কথা, এটা প্যারীচাঁদ লেন তো?
আমি বললুম, না– পটলডাঙা লেন।
-ওই দেখুন রাস্তাতেও গণ্ডগোল। ধ্যাৎ ভালো লাগে নাকি? কী বিচ্ছিরি ভুল দেখুন তো?
লোকটার কথাবার্তা অদ্ভুত লাগছিল। মাঝরাতে জানালা বেয়ে ঘরে ঢুকে এ আবার কী রসিকতা শুরু করলে। বললুম, ব্যাপার কী হে, তোমার মাথা খারাপ নাকি?
-মাথা খারাপ হতে যাবে কেন স্যার? আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে? আমি চোর।