বাবা বললেন, হুঁ।
ব্রাহ্মণ-ভোজনের ব্যাপার, গেলে ভদ্রলোকের
মুখের কথাটা লুফে নিয়ে বাবা বললেন, ভদ্রলোকের স্বৰ্গত বাপের গলায় পিণ্ডি সেঁধোবে না–এই তো? তা নাই সেঁধোল–এই বাদলার দিনে একবেলা উপোস করে থাকলেও তাঁর ক্ষতি হবে না। ভেবেছ, এই বৃষ্টির ভেতরে আমি তোমাদের বেরুতে দেব? তারপর ভিজে তিনজনের নিমোনিয়া হলে ডাক্তারের কড়ি গুনবে কে? যাও–এখন ঘরে বসে লজিক পড়ো গে। বিকেলে আমি পরীক্ষা নেব।
হাঁড়ির মতো মুখ করে ফুচুদা পালিয়ে এলেন।
ছোট বোন আনি অত্যন্ত ফাজিল। বললে, ফুচুদা–একটা কোলাব্যাং মেরে উঠোনে চিৎ করে রাখো–এখুনি বৃষ্টি ধরে যাবে।
ফুচুদা দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, যা-যা—
কিন্তু কপাল ভালো, হঠাৎ ঝাঁ করে বৃষ্টিটা থেমে গেল।
আর কথাবার্তা নেই-ফুচুদা আমাদের দু ভাইকে বগলদাবা করে সোজা ছুট দিলেন ইস্টেশনের দিকে। দশটার ট্রেনটা আধঘণ্টা আগেই বেরিয়ে গেছে আরও আধঘণ্টা পরে এগারোটার গাড়ি পাওয়া গেল। আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে ফুচুদা বললেন, দেখলি তো ট্রেনটা কী রকম পেয়ে গেলাম। আরে, শাস্ত্রে কী বলেছে জানিস? ব্রাহ্মণ-ভোজনের নিমন্ত্রণ যে অবহেলা করে, তাকে চৌষট্টি হাজার রৌরব আর কুম্ভীপাক নরকে বাস করতে হয়।
আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কোন শাস্ত্রে আছে ফুচুদা?
ফুচুদা গম্ভীর হয়ে বললেন, পেটার্থ-সংহিতায়। লিখেছেন অগস্ত্য মুনি। দুনিয়ার সেরা পেটুক–এক চুমুকে সমুদ্রটাকেই জলপান করে ফেলেছিলেন।
ট্রেনটা সবে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়েছে এমন সময় আবার বৃষ্টি।
ফুচুদা বললেন, তা হোক। খায়েঙ্গা ইয়া মরেঙ্গা। সাইক্লোন হলেও কেউ আজ আর ঠেকাতে পারবে না। আহা হা-বিরোলের কই আর রাধিকাপুরের চমচম–একখানা মণিকাঞ্চন যোগ যা হবে।
উস্-উস্ করে জিভে জল টেনে নিয়ে বাজখাঁই গলায় ফুচুদা বিকট রাগিণী ধরলেন :
“যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে রত
পান্তুয়া শত শত,
আর ধানের মতন হ’ত মিহিদানা
বুঁদিয়া বুটের মত,
আমি গোলা ভরে তুলে রাখতাম গো—
দশ-বারো মিনিটের পথ। বিরোল স্টেশনে এসে যখন আমরা নামলাম তখন প্রবল বৃষ্টিতে চারিদিকের কোনও কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। মোটা মোটা ধারায় অশ্রান্তভাবে জল পড়ছে আর বৃষ্টির রেণু যেন ঘন কুয়াশার মতো আকাশ বাতাস মাঠ-ঘাটকে ঢেকে ফেলেছে। কোনওখানে জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
সঙ্গে ছাতা ছিল। কিন্তু সে বৃষ্টি কি আর ছাতায় বাগ মানবার পাত্র! রাস্তাও কম নয়–স্টেশন থেকে প্রায় একটি মাইলের ধাক্কা!
আমরা বললাম, ফুচুদা–যা বৃষ্টি, একটু স্টেশনে দাঁড়িয়ে গেলে হয় না?
ফুচুদা বললেন, বৃষ্টি! বৃষ্টি তো হয়েছে কী? বর্ষাকালে আকাশ থেকে জল পড়বে না তো পাকা তাল পড়বে নাকি? চল চল। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, আরও দেরি করে গেলে বাকি ন’টা বামুনে সব কটা কই মাছ আর সবগুলো চমচম বেমালুম মেরে দেবে। খানিকটা ঝোল আর খানিক রস ছাড়া আর কিছু জুটবে না তা হলে। নে–বেরিয়ে পড়। গায়ে একটু জলের ছিটে না লাগতেই ছাগলের মতো ঘরের দাওয়া খুঁজে বেড়াস, জীবনে কী করে উন্নতি করবি–অ্যাাঁ?
তা বটে। জীবনে উন্নতি করাটা খুবই দরকার বলে শুনেছি। কিন্তু এমন প্রাণান্তিক নেমন্তন্ন না খেলে সে-উন্নতি যে হতে পারে না, এ কথা কখনও শুনিনি। তবু বেরুতেই হল।
ফুচুদা বললেন, দুর্গা-দুগা–দুর্গে দুর্গতিনাশিনী। কিন্তু বৃষ্টির শব্দে দেবী বোধহয় ফুচুদার কথা ভাল করে শুনতে পাননি। দুর্গতিনাশিনী না শুনে শুনেছিলেন বোধ করি ‘দুর্গতি-দায়িনী’। তাই পরমানন্দে দুর্গা আমাদের দুর্গতি শুরু করে দিলেন।
রেললাইনের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় তার যা শ্রী হয়েছে ভাষায় তার বর্ণনা সম্ভব নয়। হাঁটু-প্রমাণ কাদার তলায় জুতো চালান হয়ে যেতে লাগল। পা উঠে এল জুতো এল না। কাদা হাতড়ে হাতড়ে–যেমন করে লোকে জিওল মাছ ধরে, তেমনি করে আমরা জুতো উদ্ধার করতে লেগে গেলাম।
বৃষ্টি পড়ছে সমানে। ছাতার ভেতর দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া আসছে– কই মাছের সঙ্গে চমচমের মতো মণিকাঞ্চন যোগ হয়েছে। জামাকাপড়ের আধ ইঞ্চিও শুকনো নেই ঠাণ্ডা হাওয়ায় আর বৃষ্টির জলে আমরা হিহি করে কাঁপছি।
ফুচুদা বুক ঠুকে বললেন, ইসমে ক্যায়া হ্যায়? ধৈর্য চাই বুঝলি ধৈর্য চাই। দ্যাখ–বিদ্যেসাগর মশাই
নীতিমুলক গল্পটা শেষ হওয়ার আগেই ফুচুদার আর্তনাদ উঠল : আরে–আহা-হা
দমকা হাওয়ায় ফুচুদার ছাতাটা বেমালুম উলটে গেছে। আরে মোলো
প্রাণপণে ছাতায় চাপ দিয়ে ঠিক করতে গিয়েই–মট মট। দু দুটো শিকের গয়াপ্রাপ্তি।
ধ্যাত্তোর–যাত্রাটাই খারাপ–এতক্ষণে ফুচুদার স্বীকারোক্তি, কিন্তু দমবার লোক নন তিনি। বললেন, তা হোক। খাওয়াটা ভালোই হবে কী বলিস? বিরোলের কই আর রাধিকাপুরের চম–
কিন্তু বাকি ‘চম’টা বলবার আগেই দম–একেবারে আলুর দম। ফুচুদা কাদায় ভূত হয়ে গাত্রোত্থান করতে না করতেই আবার অধঃপতন! এঁটেল মাটিতে পা আর দাঁড়ায় না।
দৃশ্যটা উপভোগ করব কী–ততক্ষণে দু’ভাই–আমি প্যালা, আর মেজদা ন্যালা, দুজনেই আছাড় খেয়ে পড়েছি। পাঁচ মিনিট ধস্তাধস্তির পরে তিনজনে যখন উঠে দাঁড়াতে পারলাম, তখন কেউ কাউকে চেনা তো দূরের কথা নিজেরাই নিজেদের চিনতে পারছি না। একটু আগেই প্যালারাম ছিলাম তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু এখন আমি কে? কাদায় যা অবস্থা হয়েছে, তাতে তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি এখন আমিও হতে পারি, মেজদা ন্যালাও হতে পারি–এমন কি ফুচুদা হওয়াও আশ্চর্য নয় বোধহয়!