ম্যায় প্যার করনে ওয়ালে… কানার চমক ভাঙে, কার্নাইল সিং রেডিয়োটা খুলে দিয়েছে।
ওই স্বভাব কানাইল সিংয়ের। রেডিয়ো খুলে দেয় কিন্তু কখনো শোনে না, নিজের চৌকিতে বসে সামনের ছোটো বাক্সটার ওপর একটা পাঞ্জাবি খবরের কাগজ বিছিয়ে একমনে পড়ে। সকালের কাগজ রাতে-দিনেও পড়া শেষ হয় না কার্নাইল সিংয়ের। এখন হোটেলে খরিদ্দার নেই, কাজের চাপও নেই, হোটেলের বাচ্চা ছেলেটা গানটার সঙ্গে তালে তালে পা ঠোকে, গুনগুনিয়ে ধরতে চায় সুরটা।
বিরক্ত হয়ে তাকে ধমক লাগায় কানা।
ভাগ বদমাশ কাঁহাকা।
হি-হি করে হেসে ওঠে ছেলেটা। বাইরে গিয়ে বিড়ি ধরায় একটা। যেন কানাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বিশ্রী বেসুরো গলা চড়িয়ে দেয়।
ম্যায় প্যার করনে ওয়ালে…
বদমাস কাঁহাকা! কথাটা নিজের কানে লাগে। এ কানা এ বদমাশ। ডাকটা সেও শুনত। সেও বোধ হয় এরই মতো বয়েসে, কিংবা আরও ছোটো ছিল তখন—হোটেলে কয়লা ভাঙতে আর বর্তন-উর্তন সাফা করতে এসেছিল।
তার কেউ ছিল না, এই ছেলেটার মা-বাপ আছে। বাপ কুলি, মা গৈঠা বিক্রি করে। সে রাত কাটাত হোটেলের মেজেতে, শীতের রাতে ঘন হয়ে বসত উনুনটার পাশে। অনেক রাত পর্যন্ত গরম থাকত সেটা। তখন মায়ের বুকে ঘুমুবার কথা ভেবে তার কান্না আসত।
কীসের মা? হারামি।
সামনে দিয়ে একটা বড়ো সাদা গাড়ি বেরিয়ে যায়, বহুত ভারী আদমির গাড়ি। কোনো পাঞ্জাবি বড়োলোক। সোনার চশমাপরা একজন, একজনের মাথার পাগড়ি। ফুটফুটে কয়েকটি মেয়ের মুখ। দু-তিনটে বাচ্চা। এখন চলল হাওয়া বদলে। ক্যারিয়ার পুরো বন্ধ হয়নি, মালপত্রে বোঝাই।
কত দূরে চলল? হয়তো আগ্রা-দিল্লি ছাড়িয়ে একেবারে নিজের দেশে পাঞ্জাবে। অত বড়ো গাড়ি রেলগাড়িকে টেক্কা দিয়ে কোথা থেকে কোথায় ছুটে যাবে।
রেল কলোনির পুরোনো বাড়িগুলোর মাথার ওপর দিয়ে নীল ফুটেছে, মেঘের গায়ে রাঙা রোদ। তারও দেশ ছিল পাঞ্জাবে। কিন্তু কানা কখনো দেশ দেখেনি। দেখেনি লাহোর থেকে কোথায় বিশ মাইল দূরে তার গাঁ। দেখেনি জলন্ধর, যেখানে তার চাচা নাকি বড়ো ব্যাবসাদার আর অনেক টাকার মালিক। দেখেনি অমরুতসর, তার সোনে কা মন্দির, রানিগঞ্জ আসানসোল-দুর্গাপুর-হাজারিবাগ-কলকাতা ব্যাস, ব্যাস।
ব্যাস সব ফুরিয়ে গেছে। এক-পা খোঁড়া, এক চোখ কানা, বয়েস চল্লিশ হতে চলল। বাকি জীবনটা কেটে যাবে এই কার্নাইল সিংয়ের হোটেলে। যদি বুড়ো কানাইল মরে যায় হঠাৎ, হোটেল উঠে যায় তার, এই আসানসোলেই অন্য হোটেলে কাজ জুটে যাবে। কানা সিংয়ের নাম আছে রান্নায়।
রেডিয়োতে আবার একটা ফিলমি গান শোনা যায়। বাচ্চাটা বাইরে থেকে ফিরে এসে চেয়ার-টেবিলগুলো অকারণে নাড়াচাড়া করে—যেন কাজ করছে। কানার হাসি পায়। ওর আসল কান ওই গানের দিকে।
অ্যাই–বদমাশ বলতে গিয়েও সামলে নেয় কানা, থোড়া আদরত লাও।
আদার দরকার নেই, তবু হুকুম করতে ভালো লাগে। না, এই ছেলেটার উপর তার মায়া হয় না, কেউ তাকেও মায়া করেনি। এই ছেলেটা রাত্রে তার গৈঠাওয়ালি মায়ের বুকের ভেতর আশ্রয় পায়। সে শুয়ে থাকত উনুনের ধারে। যখন উঠত, তখন সারা গা তার ছাইয়ে মাখামাখি।
এ কানা। এ বদমাশ।
এই ছেলেটারও একটা চোখ কানা হতে পারত, একটা পা খোঁড়া হতে পারত—হয়নি। শয়তানিতে দুটো চোখই ওর বিল্লির মতো জ্বলে। কানা যদি কখনো চটেমটে এক-আধটা চড়চাপড় বসাতে যায়, একেবারে রামছাগলের বাচ্চার মতো তিড়িং করে ছুটে পালায়। খোঁড়া পা নিয়ে কানা ধরতে পারে না তাকে। প্রাণখুলে গালাগালি করে কদর্য ভাষায়—দূরে দাঁড়িয়ে হি-হি করে হাসে ছেলেটা।
কানাইল সিং নজর দেয় না ওসবে। সকালের খবরের কাগজটা দিনমান ধরে পড়ে, কী পড়ে সে-ই জানে। পয়সাকড়ির হিসেব করে। আর তেমন তেমন খরিদ্দার এলে আদর আপ্যায়ন করে একটু। কানের কাছে রেডিয়োতে গানা চলে, অথচ কখনো শোনেও না। মেজাজ খুশি থাকলে, অর্থাৎ পয়সাকড়ির আমদানি একটু বেশি হলে তাকে গুনগুন করতে শোনা যায়।
ধন ধন পিতা দশমেশ গুরু, জিনহি চিড়িয়াসে বাজ তোড়ায়ে—
দশমেশ গুরু-গুরু গোবিন্দ। তারপর আর গুরু নেই। সব বান্দা।
এসব খবরও কি রাখত নাকি কানা? কানাইলই তাকে শুনিয়েছে।
গুরু গোবিন্দ। কী অসাধ্য ছিল তাঁর? ছোটো পাখি দিয়ে বাজ শিকার করিয়েছেন, তিনিই তো শিখিয়েছিলেন শিখদের পাঁচ ক ধারণ করতে হবে—কেশ, কাঁকই, কঙ্গন, কৃপাণ…
বলতে বলতে হাসে কানাইল সিং।
কানা, তুমিও শিখ।
জি।
কিন্তু তোমার চুল নেই, দাড়ি নেই, কৃপাণ নেই, কাঁকই নেই।
থাকবার মধ্যে কেবল ডান হাতের কঙ্গন-লোহার বালাটা।
দেশে গেলে শিখেরা রাগ করবে তোমার ওপর। বঙ্গাল বলেই পার পেয়ে গেলে।
দেশ! পাঞ্জাব! সে রানিগঞ্জে জন্মেছে। কোনোদিন দেশে যায়নি, কখনো যাবে না। তার সামনে দিয়ে পাঞ্জাব যেন ছুটে যায়, ছুটে যায় কালকার গাড়ি। তার দেশের মানুষরা ছোটে ঘরমুখো। অমরুতসর, জলন্ধর, আম্বালা, লালান, চন্ডীগড়–কোথায়, কতদূরে! ভারী আদমিদের বড়ো বড়ো মোটরগাড়ি হাজারিবাগ-গয়া-বানারস পাড়ি জমায়, হয়তো অমরুতসর-চন্ডীগড়েও চলে যায় রেলগাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কানা রেলের লাইন দেখে, জিটি রোড দেখে, আর এমনি কোনো সময়—যখন শেষরাতের হাওয়ায় গায়ে একটা শিরশিরানি জাগে হঠাৎ, তখন আকাশের নীল দেখে।