কী বললেন?
ঠিক বলছি, আমার গায়ে বেশি জোর আছে, সুতরাং তুমি আমাকে মেনে চলবে। কাজেই আমার মতো বয়স্ক লোকের মুখের সামনে তুমি যে অসভ্যের মতো কথা বলছ, বাঁদরের মতো সিগারেট ধরিয়েছ, তার জন্যে এক্ষুনি তোমায় ক্ষমা চাইতে হবে।
ক্ষমা চাইব?–আলু হা হা করে হেসে উঠল : হাতি ঘোড়া গেল তল, মোসা বলে কত জল! আপনার মতো কত মক্কেলকে আমি ইট মেরে–
আর বলতে হল না। এইবার ন্যায়বিচারের সময় হয়েছে।
হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে গড়গড়ি বললেন, আমার জোর পরখ করতে চাও বুঝি? বেশ, বেশ!
তারপর দুম দুম শব্দে দুটি কিল পড়ল আলুর পিঠে। মাত্র দুটি। আলু তাতেই আলুর দম–একেবারে চোখ উলটে বসে পড়ল ঘাসের ওপর–মনে হল সে গুঁড়ো হয়ে গেছে!
গল্পটা এখানে শেষ নয়।
আলু অর্থাৎ আলোক চৌধুরী আজকাল প্রোফেসার গড়গড়ির সব চেয়ে ভক্ত শিষ্য। পাড়ার গুণ্ডাদমন সমিতির সে ক্যাপ্টেন, লোকে বলে, খাসা ছেলে। এমন কি টুকলি না করেই, সে ফার্স্ট ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে এবার।
আর কাবুল–মানে স্কলারশিপ পাওয়া জুয়েল ছাত্র কমল গুপ্ত, এখন তার প্রাণের বন্ধু। কমল গুপ্তের হাতের মাসলও এখন দেখবার মতো–আলোক আর কমল পাঞ্জা লড়লে কে জিতবে, জোর করে বলা শক্ত।
আসানসোলের লোকটা
এককালে একটা নাম নিশ্চয় ছিল। সেটা তার বাপ জানত, মা-ও জানত নিশ্চয়। কিন্তু বাপ খতম হয়ে গেল জিটি রোডে মাঝরাতে নেশার ঘোরে লরি চালাতে গিয়ে, মা যে কোথায় উধাও হল কেউ জানে না।
তারপর এখানে-ওখানে। এর দোরে, তার দোরে।
একটা চোখ কানা, একটা পা ছোটো। সব দিক থেকে মার-খাওয়া। কী-আর কাজ জুটবে? হোটেলে কয়লা ভাঙা, বর্তন-উর্তন সাফ করা, উনুন-ধরানো, সবজি কাটা, ফাইফরমাস, চড় লাথি।
এ কানা, এ বদমাশ।
এক-পা ছোটো, এক চোখ কানা। বদমায়েশি করবার সুযোগ নেই কোনো। তবু এ কানা, এ বদমাশ এই নামই দাঁড়িয়ে গেল।
এখন চল্লিশ ধরো-ধরো। অনেক দেখেছে, অনেক ঘাটের জল খেয়েছে, ঘুরেছে নানা জায়গায়। কিন্তু হোটেলের কাজ ছাড়া আর কিছুই জুটল না কোথাও। আর কোনো কাজেরই যোগ্যতা নেই তার।
বিয়েও করেছিল বই কী—যদি তাকে বিয়ে বলা যায়। একটা ছোটো ঘরভাড়া করে সেই ধানবাদে থাকবার সময় হাজারিবাগ জেলার কালোকোলো একটি মেয়েকে নিয়ে সংসারও পেতেছিল একবার। কিন্তু কালো হলে কী হবে, সুরত ছিল মেয়েটার—অন্তত লোকে তাই বলত। তার মন টেকে কানা-ল্যাংড়ার ঘরে? কার সঙ্গে একদিন কোথায় চলে গেল একেবারে।
মা অন্তত বাপটা মরা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল, কিন্তু ততটুকু দেরিও এর সইল না।
ঘেন্না ধরে গেছে তারপর থেকে। জাতটাই হারামি। নিজের মা-টাকেও তো দেখল।
এখন চল্লিশ ধরো-ধরো বয়েস। এ কানা, এ বদমাশ কেউ আর বলে না। এখন শুধুই কানা। তা চাকরিতে উন্নতি হয়েছে বই কী। আর কয়লা ভাঙতে হয় না, বর্তন সাফা করতে হয় না, চড়-লাথিও খেতে হয় না তাকে। কানা এখন রান্না করে হোটেলে। সব পথ শেষ করে আসানসোলে এসেই থিতু হয়েছে এখন। হোটেলের মালিক বুড়ো কানাইল সিং ফৌজে ছিল একসময়। মস্ত দাড়ি, মস্ত শরীর, মনটাও নেহাত ছোটো নয় তার। কানাইল সিং পছন্দ করে কানাকে।
কানা রাঁধে ভালো। তার হাতের তৈরি মাংস আর আলু-মটরের নাম আছে বাসওয়ালা আর কোলিয়ারি এলাকার সর্দারজিদের মহলে। হয়তো এইজন্যেই একটু খাতির আছে তার কার্নাইল সিংয়ের কাছে।
কিন্তু এ কানা। ওইটেই তার নাম।
তুমি তো শিখ। একজন জিজ্ঞেস করেছিল।
নিশ্চয়।
তাহলে তো শুধু কানা হতে পার না। সিং, কানা সিং।
তাই সই। একটু জাতে ওঠা গেল তাহলে। কানা সিং।
বেলা উঠতে থাকে, আসানসোলের রাস্তায় গাড়ির ভিড় বাড়ে। জিটি রোড পার হয়ে, রেলের লাইন ছাড়িয়ে, রেল কলোনির লাল লাল জীর্ণ বাড়িগুলোর মাথার উপর দিয়ে কানা আকাশটাকে দেখে। সাদা সাদা মেঘ ছিঁড়ে নীল দেখা দিয়েছে, লাল রোদ পড়েছে মেঘের গায়ে। ভোররাতের হাওয়ায় কালো ঠাণ্ডার যেন আলগা ছোঁয়া লাগল একটু। কানা জানে, জানে আর কদিন বাদেই বাঙালিদের পুজো আসবে। আসানসোল শহর, তার বাজার, সব কেঁপে উঠতে থাকবে ঢাকের শব্দে, মাইকের গানে। আকাশের ওই নীল তার খবর।
জিটি রোডে প্রাইভেট গাড়ির ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকবে এখন। কলকাতা থেকে পয়সাওয়ালা মাড়োয়ারি-পাঞ্জাবি-গুজরাতি-সিন্ধি-বাঙালি সব মোটর নিয়ে চলল হাওয়া বদল করতে। চলল নিয়ামতপুর থেকে ডাইনে ঘুরে চিত্তরঞ্জন হয়ে জামতাড়া-দেওঘর-জসিডির দিকে, চলল বরাকরের রাস্তা ধরে ধানবাদ-হাজারিবাগ হয়ে পাটনা-গয়া-কাশী-দিল্লির দিগবিদিকে। জিটি রোডে এখন ছুটির ডাক।
কানার আর কোথাও যাবার নেই, তার সব চলা শেষ। এখন কার্নাইল সিংয়ের হোটেল, আলুমটর, কড়াই ডাল, আলু-পালং, কুচো চিংড়ির তরকারি, মাংস, রুটি। ওই সব গাড়ি করে যারা যায় এ হোটেলে তারা থামে না, তাদের জন্যে একটু দূরে দোতলা হোটেল আছে, বিলাইতি দারুর ব্যবস্থা আছে। এখানকার খরিদ্দার আলাদা, তারা বাস-লরির ড্রাইভার কণ্ডাকটার ক্লিনার, তারা কোলিয়ারি এলাকার সর্দারজি।
কিন্তু দূরে ছুটে-যাওয়া ওই হাওয়া বদলের গাড়িগুলো কানাকে উদাস করে। হাতের ডাণ্ডাটা নিয়ে লম্বা পাত্রটার মধ্যে প্রাণপণে মাংস কষতে কষতে চোখ চলে যায় আকাশের নীলের দিকে। যে-বউটা পালিয়ে গেল, অন্য সময় যাকে স্রেফ হারামি ছাড়া আর কিছু মনে হয় না তার, তারই জন্যে বুকের ভিতর কেমন একটা যন্ত্রণা হতে থাকে।