কতদূর আর গড়াবে! একটু পরেই জোয়ান ছেলেটা রোগা ছেলেটিকে চিত করে ফেলে তার বুকে চড়ে বসল। তারপর যখন জুত করে আরও মারতে যাচ্ছে, তখন গড়গড়ি একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বিজয়ীকে তুলে আনলেন। বললেন, ব্যাস, হয়ে গেছে। এইবার শেক-স্যান্ড করো–তারপর সোজা বাড়ি চলে যাও।
মোটা ছেলেটা তো আর ইংরেজের বাচ্চা নয় যে এসব কথা সে বুঝবে! সে পালটা চোখ পাকিয়ে বললে, আপনি কে মোসাই ফরফর করতে এসেছেন? আমি ওর বদন বিগড়ে দেব! আলুকে ও এখনও চেনে না।
ছেলেটির মেজাজ দেখে প্রোফেসার গড়গড়ি বেশ কৌতূহল বোধ করলেন। ওঃ, তোমার নাম বুঝি আলু? তুমি বুঝি খুব বিখ্যাত লোক?
আলু চোখ বাঁকা করে এমন ভাবে তাকাল–যেন সম্রাট আলেকজান্ডারকে প্রশ্নটা করা হয়েছে।
মোসাই বুঝি অন্য পাড়ার লোক?
ছিলুম আগে। এখন দিন তিনেক হল তোমাদের পাড়ার বাসিন্দে হয়েছি।
অ।–আলু চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, তাই আমার নাম শোনেননি এখনও। শুনবেন শুনবেন, আস্তে আস্তে শুনবেন।
বেশি শোনবার দরকার নেই, এতেই বোধহয় তোমাকে চিনতে পারছি। তা মারামারি করছিলে কেন এর সঙ্গে?
মারামারি! ফুঃ! আলু যেন কথাটা ফুঁয়ে উড়িয়ে দিলে : ওই ফড়িংটার সঙ্গে মারামারি করব? পিটছিলুম মোসায়, হাতের সুখ করে নিচ্ছিলুম। ফড়িংটার সাহস দেখুন–পালটা লড়ে যাচ্ছে আমার সঙ্গে। আপনি চলে যান মোসাই, আমি ওকে তুলোধোনা করে দিচ্ছি।
গড়গড়ি চেয়ে দেখলেন রোগা ছেলেটির দিকে। ঘাসের ওপর বসে পড়ে সে হাঁপাচ্ছে। তার শার্ট ছেঁড়া, ঠোঁটের কোণে রক্ত। চোখে একটু জলও দেখা গেল যেন।
গড়গড়ি বললেন, তোমার নাম কী?
রোগা ছেলেটা গোঁজ হয়ে রইল, জবাব দিলে না। আলু বললে, ও? ওর নাম কাবুল।
তাই বুঝি আলু আর কাবুলে মিলে আলকাবলি তৈরি হচ্ছিল?
হে-হে-হেঃ!–আলু হেসে উঠল : মোসাই তো বেশ মজা করে কথা বলতে পারেন। তা স্যারের নামটা কী? বলে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল। প্রোফেসার গড়গড়ি আড়চোখে একবার চেয়ে দেখলেন কেবল।
রোগা ছেলেটি–অর্থাৎ আলুকাবলির কাবুল তখন উঠে চলে যাওয়ার উপক্রম করছিল। প্রোফেসার গড়গড়ি মোটা গলায় বললেন, দাঁড়াও হে ছোকরা, দরকারি কথা আছে। তাঁর গলার আওয়াজে এমন একটা কিছু ছিল যে ছেলেটা থমকে গেল, এমন কি বেপরোয়া আলুর পর্যন্ত হাতটা সিগারেটসুদ্ধু কেঁপে উঠল একবার।
আলু বললে,বেশ জবরদস্ত গলাটি তো মোসাইয়ের। তা নামটা বললেন না?
হবে এখন, নামের জন্যে ভাবনা কী!–গড়গড়ি হাসলেন : আমাকেও আস্তে আস্তে চিনবে। তা ওকে তুমি মারছিলে কেন?
মারব না?–আলু গড়গড়ির মুখের ওপরেই একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিলে : ও আমাকে গেরাজ্যি করে না।
করে না নাকি?
একেবারে না। ক্লাসের ফার্স্ট বয় কিনা, অহঙ্কারে পা পড়ে না মাটিতে, আমি ফেল করি, টুকলিফাই করি–এসব বলে বেড়ায়।
করিসই তো ফেল, টুকলিই তো করিস–কাবুল কাঁদো কাঁদো গলায় বললে।
আলু প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল তার ওপর–গড়গড়ি মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, হচ্ছে, হচ্ছে, ঠ্যাঙানি তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। কাবুল, ডোন্ট ডিসটার্ব আলুকে বলতে দাও।
আলু বললে, ওসবে আমি গ্রাহ্যি করি না মোসাই। আমার বাপের পয়সায় আমি ফেল করি, হাতের জোরে টুকলি করি, ভয় পাই নাকি? কথাটা কী জানেন, ও আমাকে একদম খাতির করে না।
তোমাকে খাতির করা দরকার বুঝি?
দরকার নয়? আমার গায়ে জোর আছে। পাড়ার ছেলে বুড়ো আমার নামে কাঁপে।
ও কাঁপে না?
না। কাল সিনেমায় যাব বলে ওর কাছে একটা টাকা চেয়েছিলুম, দেয়নি। পরশু বলেছিলুম, চপকাটলেট খাওয়া-বলেছে গুণ্ডাকে আমি খাওয়াই না। টিংটিঙেটার আস্পর্দা দেখেছেন?- বলেই আবার সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল।
গড়গড়ি বললেন, ঠিক।
ঠিক না?–আলু মুরুব্বিয়ানা চালে হাসল : মোসাই দেখছি বেশ সমঝদার লোক।
গড়গড়ি এবার কটমট করে তাকালেন কাবুলের দিকে। দ্যাখো ছোকরা, ক্লাসের ফার্স্ট বয় হলেই হয় না। গায়ে যদি জোর না থাকে, তা হলে জোয়ানদের কথা মানতে হবে, আর নইলে মার খেতে হবে। দুনিয়ায় এই নিয়ম।
কাবুলের চোখ জ্বলে উঠল : দুনিয়া বুঝি গুণ্ডাদের জন্যে?
না, শক্তিমানের জন্যে।–গড়গড়ির স্বর কঠোর হল : মন আর শরীর দুটোই শক্ত হওয়া দরকার। শুধু ফার্স্ট বয় হলেই চলে না। মাসলও জোরালো করতে হয়। হয় গুণ্ডার কাছে হার মানো নইলে গুণ্ডাকে ঠাণ্ডা করো–আর কোনও রাস্তা নেই। তোমাকে আলু পিটিয়েছে, বেশ করেছে। ইউ ডিজার্ভ ইট।
কাবুল আবার বোঁ বোঁ করে চলে যাচ্ছিল, গড়গড়ি সেই ভয়ঙ্কর গলায় বললেন, দাঁড়াও।
কাবুল চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, এমন কি গলার আওয়াজটা আলুরও ভালো লাগল না। সিগারেটে আর একটা সুখের টান দিয়ে বললে, মোসায়ের গলাটি বেশ জোরালো। কিন্তু কথাটা বলেছেন বেড়ে। জোর যার মুল্লুক তার।
গড়গড়ি বললেন, ঠিক।
আলু উৎসাহ পেয়ে বললে, যার জোর আছে তাকে মানতে হয়। নইলে ঠ্যাঙানি খেতে হয়।
গড়গড়ি বললেন, তা-ও ঠিক।
তা হলে মোসাই কথাটা বুঝিয়ে দিন ওদিকে। আজ আপনি এসেছেন বলে পার পেয়ে গেল,নইলে আমি ওকে
গড়গড়ি বাধা দিয়ে বললেন, বলতে হবে না। কিন্তু তোমাকেও যে একটা কথা বোঝাবার আছে হে আলু।
আলু খিকখিক করে হেসে বললে, আমাকে।
হ্যাঁ, তোমাকে। আমি যদি বলি, আমার গায়ে তোমার চেয়ে বেশি জোর আছে-মানবে তো আমাকে?