- বইয়ের নামঃ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পসমগ্র
- লেখকের নামঃ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অথ নিমন্ত্রণ ভোজন
পিসতুতো ভাই ফুচুদার সবই ভালো, কেবল নেমন্তন্নের নাম শুনলেই তাঁর আর মাথাটা ঠিক থাকে না।
দিব্যি আছেন ভদ্রলোক, খাচ্ছেন দাচ্ছেন, বাঁশি বাজাচ্ছেন। কোনও ঝামেলা নেই। এমন সময় হঠাৎ শুনতে পেলেন রাঘব মুখুজ্যের বাপের শ্রাদ্ধে নেমন্তন্ন করে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফুচুদার ভাবান্তর। দু’দিন আগে থেকে খাওয়া কমিয়ে দিলেন, তারপর শুরু করে দিলেন ডন আর বৈঠকী। শরীর ভালো করা চাই, খিদেটাকে চাগিয়ে তোলা চাই। পরস্মৈপদী লুচি-পান্তুয়া যত বেশি পেটস্থ করে আনা যায় ততই লাভ!
বর্ণনাটা শুনে মনে হতে পারে লোকটি ইয়া তাগড়া জোয়ান–বুকের ছাতি বুঝি বাহান্ন ইঞ্চি! কিন্তু ভুল–একদম ভুল। আমি শ্রীমান প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে–পালাজ্বরে ভুগি, বাসকপাতার রস আর চিরতা খেয়ে প্রাণটাকে ধরে রেখেছি। সুতরাং যারা আমাকে দেখনি তারাও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ আমার চেহারাটা কী রকম। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবে না–সেই আমি স্বয়ং শ্রীমান প্যালারাম–ল্যাং মেরে ফুচুদাকে চিৎপটাং করে দিতে পারি। অর্থাৎ ফুচুদা রোগা একেবারে প্যাঁকাটির মতো–ঝাঁকড়া চুলওয়ালা মাথাটি দেখতে একটা খেজুরগাছের আগার মতো–আর পিলেতে ঠাসা পেটটা দেখলে মনে হয় কোনদিন সেটা বেলুন হয়ে ভদ্রলোককে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
এই তো চেহারা–কিন্তু আহারের ক্ষমতাটি অসাধারণ। অত বড় পিলের সাম্রাজ্য পেটে নিয়ে লোকটা লুচি-মণ্ডাগুলো যে কোথায় রাখে এ একটা গুরুতর ভাবনার বিষয়। ক্লাসে অঙ্কের পরীক্ষায় আমি প্রায়ই গোল্লা খাই। তবু অনেক চিন্তা করে আমার মনে হয়েছে ফুচুদার পেটের পরিধি নির্ধারণ করার চাইতে স্কোয়াররুটের অঙ্ক কষাও সোজা।
এই ভদ্রলোকের পাল্লায় পড়ে একবার একটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলাম।
জীবনে অনেক দুঃখই ভুলেছি। এমন কি গত বছর খেলার মাঠে কাটা-ঘুড়ির পিছনে ছুটবার সময় একটা নেড়ী কুকুর যে আমার বড় সাধের নতুন আলবার্ট জুতোজোড়া আমসত্ত্ব ভেবে চিবিয়ে খেয়েছিল, তা পর্যন্ত ভুলে যেতে রাজি আছি। কিন্তু ফুচুদার সঙ্গে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে গিয়ে যে সাংঘাতিক দাগা পেয়েছিলাম মরে গেলেও সে আমি ভুলব না।
থাকি মফস্বল শহর দিনাজপুরে–পড়ি জেলা ইস্কুলে। এমন সময় আমাদের দু’ভাইয়ের পৈতে হল। আমি প্যালা, আর মেজদা ন্যালা কানে বেলকাঁটার ফুটো নিয়ে নাক টিপে প্রাণায়াম করি আর পঞ্জিকা খুলে খুলে খুঁজি কবে সায়ংসন্ধ্যা নাস্তি!
তোমাদের ভেতরে যাদের পৈতে হয়েছে তারা নিশ্চয় জানো যে, এই সময় ব্রাহ্মণবটুদের দামটা কী রকম বেড়ে যায়। পাড়ার বুড়িদের যত ফলদানের ব্রত–সে তো আমাদের বাঁধা! দ্বাদশজন ব্রাহ্মণ-ভোজনেও আমাদের ডাক পড়বেই। বেশ সুখেই ছিলাম সন্দেহ কী।
আমাদের এক আত্মীয় আছেন–নাম শ্যামানন্দ চৌধুরী। থাকেন দিনাজপুরের পরের স্টেশন বিরোলে সেখানে যেন তাঁর কী একটা ব্যবসা আছে।
হঠাৎ শ্যামানন্দবাবুর শখ হল, তিনি তাঁর বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধে জন কয়েক ব্রাহ্মণ-ভোজন করাবেন।
বিরোল জায়গাটি ছোট। একটি বাজার, খান কয়েক দোকান–একটি থানা। অনেক কুড়িয়ে বাড়িয়েও ন’জনের বেশি ব্রাহ্মণের সন্ধান সেখানে পাওয়া গেল না। সুতরাং শ্যামানন্দবাবু দিনাজপুরে এলেন বাকি তিনজন ব্রাহ্মণের খোঁজে। আর যোগাড় করলেন কাকে কাকে বলো তো? আমি প্যালা, মেজদা ন্যালা, আর পিসতুতো ভাই ফুচুদাকে।
সেদিন বিকেলেই দেখলাম, উঠনে দাঁড়িয়ে ফুচুদা প্রাণপণে মুগুর ভাঁজছেন। সে একখানা দেখবার মতো জিনিস। পাড়ার যত কাক সেদিন সেব্যাপার দেখে কা কা করে মাইল তিনেক দূরে পালিয়ে গেল। বেগুনখেতে বাঁশের মাথায় কেলে হাঁড়ি দেখলেও তাদের এত ভয় করে না।
পরদিন সকাল থেকেই নামল মুষলধারে বৃষ্টি।
সারা বছরেও বোধ হয় কোনওদিন এমন বেখাপ্পা বৃষ্টি নামেনি। আকাশের চৌবাচ্চাটা কী করে সেদিন ফুটো হয়ে গিয়েছিল কে জানে–হড়-হড় করে জল যে পড়তে লাগল তার আর বিরাম নেই।
আর অবস্থা দেখে ফুচুদার চোখ দিয়েও অমনি করে বর্ষা নামবার উপক্রম। আহা হা–বিরোলের কই মাছ বিখ্যাত–তার তিনটেতে সের হয়। তা ছাড়া আগের দিন বিকেলে শ্যামানন্দবাবু দিনাজপুর থেকে যে-পরিমাণ বাজার করে নিয়ে গেছেন তাতে ওখানে যে দস্তুরমতো একটা রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেছেন তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু যা বৃষ্টি–স্টেশনে যাওয়া তো দূরের কথা, বাড়ি থেকে বেরুনোও অসম্ভব।
শুধু ফুচুদা কেন–আমাদের মনটাও খারাপ হয়ে গেল।
দশটার ট্রেনে আমাদের যাওয়ার কথা। নটা বাজতে না বাজতেই ফুচুদা ছটফট করতে লাগলেন। ইচ্ছেটা–ওই বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়বেন।
আর থাকতে না পেরে ফুচুদা দরবার করতে গেলেন বাবার কাছে।
-মামা, ট্রেনের সময় তো হল।
বাবা ভয়ানক রাশভারী লোক–ছুটির দিন বসে বসে পড়েন মোটাসোটা ফিলজফির বই, আর সে সময় কেউ বিরক্ত করলে ভয়ঙ্কর চটে যান। ফুচুদার কথা শুনে তিনি বই থেকে মুখ তুললেন, চশমাটা নামিয়ে আনলেন নাকের একেবারে ডগাটাতে, শান্তভাবে প্রশ্ন করলেন, তাতে কী হয়েছে?
বিরোল তো যেতেই হয়—