আবার হাঁটে। ক্ষিধেয় পা টলছে। এ কোন মহাজীবন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? একটি খালি জায়গার ওপর দীর্ঘ বাড়ি হচ্ছে। কোমর অব্দি তৈরি হওয়া অর্ধনির্মিত বাড়িটির দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে যায় মইন। না, তাদের এলাকায় এমন কোন বাড়িও চোখে পড়েনি তার কিশোরবেলা থেকেই সব রাস্তা ঘাট, সিনেমা হল, অলিগলি, হাসপাতাল চেনে ফেলার পর থেকে খুব হারিয়ে যাওয়ার শখ ছিলো মইনের। কখনই কোন অবস্থাতেই সে ইচ্ছে থাকলেও হারিয়ে যেতে পারবে না—এই ভাবনাটাই চিরকাল তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে। অনেকটা ক্ষিধে, কিছুটা ভয়, হতাশা ক্লান্তির পাশাপাশি তাই আজ অনেক আনন্দও হচ্ছে তার।
পত্রিকায় খুকি যদি বিজ্ঞাপন দিতে। মইন তুমি যেখানেই যে অবস্থায় আছে, শীগগির ….। ওইতো সোজা রাস্তা। বেশ চেনা লাগছে। তবে কি হনহন হাঁটে মইন। দ্রুত হাঁটলে পথটা শীঘ্রই হরিয়ে যাওয়ার তীব্র সম্ভাবনা আছে এদিকে আবার এবড় নারকেল গাছ কি করে এলোয় কি আজব পরিস্থিতি! কোন প্রেন্সিী তাকে অদৃশ্য দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে না তো? কিছুটা ভীত মইন দ্রুত পকেটে হাত দেয়, সিগ্রেটের খোঁজে। সিগ্রেটের কোন নেশা নেই তার। অতসী সিগ্রেট পছন্দ করে। ওর সামনে, অনেকের সামনে শো করে টানে। নেশা যেহেতু নেই, সেহেতু পকেট শূন্য। কে যেন বলেছিলোসকালে খালি পেটে সিগারেট ধরাইলেই বউয়ের খ্যাচ খ্যাচানী শুরু হয়ে যায়। আরে মাতারী তুই কি বুঝবি। খালি পেটে সিগারেট না খাইলে আমার পায়খানাই হয় না।
মনে পড়ে, অফিসের কলিগ রবীন্দ্র বাবু বলেছিলো। ধুৎ! এই প্যাঁচপ্যাঁচ অসহ্য লাগছে। শরীরটা এমন ভারি হয়ে উঠলে কেন? মইন পরখ করে দেখতে চায়, প্রেতলোক থেকে সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে কীনা। তবে কী স্বপ্ন বই? অতসীর নীল শাড়ি, গোলাপির জ্বলন্ত চিতা, অপ্সরীর কোল থেকে লাফিয়ে পড়েই এই অন্ধ গলির প্যাচের মধ্যে চক্কর খাওয়া?
মনে পড়ে, বৃষ্টিতে লোকটাকে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখেও মইন পালিয়ে এসেছে—এই গল্প শুনে দয়াবতী খুকি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে। সেই চোখে কিঞ্চিৎ ঘৃণাও ছিলো। কুঁসে ওঠে মইন, ঘরে বসে বসে এক একটা পুরুষকে রূপকথার বীর রাজকুমার ভাবতে তো কষ্ট হয় না। আরে গৃহনারী, তুমি কি করে বুঝবে বিংশ শতাব্দীতে একটি অর্ধমৃত লোককে টানাটানি করা কি ঝক্কির? থানায় গিয়ে ইচ্ছে করেই নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে দেয়া নয়? জীবনকে তুমি কতটুকু দেখেছো?
ভাবতে ভাবতে মইন ডবল মার্চের ভঙ্গিতে পুনরায় বায়ে ঘুরতেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুখ। হ্যাঁ এটাইতো সেই চারতলা বিল্ডিং। যার একটি ঘরে খুকিকে নিয়ে সে বাস করে। ক্লান্ত ভাব কেটে গিয়ে ভেতরটা ফুরফুরে হয়ে উঠতেই লে শালা! এটা তো দেখছি অতসীদের বাসা। অতসী আর তার বাসার চেহারার বেশ মিল আছে। একদিন অতসীকে বলেছিলো কথাটা। আমার বাসার সামনে তো ‘আশ্রয়’ নামের কোন নেমপ্লেট ছিলো না? অতসীদের বাসায়ও ছিলো কি? অবিকল স্টাচু মইন মহা ফাপড়ে পড়ে রাজহাঁসের মতো গলা বাড়িয়ে বাড়িটিকে খুঁটে খুঁটে দেখে। না, এটা
তো তার নিজের বাড়িই। চারতলার দড়িতে ওইতো খুকির শায়া ঝুলছে।
শায়াটাতো অতসীরও হতে পারে। ওইতো অসীদের বিল্ডিংয়ের সামনের পদ্ম ফুলের কারুকাজ।
কিন্তু, ‘আশ্রয়’ নেমপ্লেট? তুমি কে হে বাপু? তুমি তো দু’বাড়ির কোথাও ছিলে, কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, নামটাতো খাসা হে। আমি তো এখন তোমাকেই চাইছি।
কিন্তু, কোত্থেকে এসেছো তুমি? মহা মুশকিল তো! সদ্য আমদানি হয়েছে? তাই হবে। হে হে ঠিক ধরেছি। আমাকে ঘোরে ফেলার মতলব?
ঘুম আসছে। পা দুটো মটমট শব্দে পড়তে চাইছে। এত রাতে যা-ও বাড়িটা খুঁজে পাওয়া গেলো, …ওইতো তিনতলার টবসহ ফুলের ঝাড়! মকবুল গিন্নির ছোট বেলার শখ! কিন্তু সামনের লম্বা ন্যাড়া নারকেল গাছটা দেখিয়েই তো অতসী বলেছিলো, আমাদের পাড়ায় এসে ন্যাড়া নারকেল গাছ বাড়ি কোনটি জিজ্ঞেস করলেই লোকে দেখিয়ে দেয়।
কি মুশকিল! কি মুশকিল!
পেটের ক্ষুধা এমন লেলিহান হয়ে উঠছে! বৈচিত্রপ্রিয় খুকি তত আট বছরের মধ্যে আমি এই একবারই এত রাত করায় শাসন করার বদলে উল্লসিত হবে, উল্লাসে যাবো?
অতসী কী জেগে আছে? নীল শাড়ি পড়া আর মধ্য রাতে প্রতীক্ষায় জেগে থাকা এক কথা?
তবে?
শরীরের ভুস ভুস গন্ধ নিজের নাকেই প্রকট লাগছে। ক্লান্তি, জ্বালা জ্বালা চোখ, থুবড়ে পড়তে চাওয়া পা দুটোকে সজোরে টান করে।
মইন ঘোরে পড়া মানুষের মতো তর্জনী নাড়ায়….তুমি যেই হও বাড়ি, খুকিই হও আর অতসীই হও, কি বলতে চাইছে তা আর বাড়ির কাছে মইনের খোলাখুলি বিশ্লেষণ করা হয়ে ওঠে না, নির্জন রাতে চাপা অথচ তীব্র স্বরে যে-ই হও, যে-ই হও। বলতে বলতে কম্পিত গলা বাড়িয়ে বাড়িটিকে খুঁটে খুঁটে দেখে। ভাবে, এখন সিদ্ধান্ত নেবো আমি।
আমি কোথায় যাবো।