এক সময় অন্য নারীর কাছে….?
কোনই প্রয়োজন নেই জটিলতার। তারচেয়ে এই ভালো, এবার আমি নেবো। আমার কল্পনার সার্বিক সুন্দর পুরুষকে, কখনো মহেন্দ্রকে, কখনো ইরফানকে, বিদেশী পুরুষকে, টেলিভিশন ঠিক করতে আসা মেকানিককে, রাস্তায় একবার দেখা কোন লোককে। এভাবে আরও আটটি বছর কাটিয়ে দেবো। তারপর? আরও আট বছর পর? আমার ঘুম পাচ্ছে। মইন কোথায় গেলো?
কি সব ভাবছি আমি! উঠে দাঁড়াই। ঘড়ি দেখি। চোখ গোল হয়ে আসে। ঘটর ঘটর ফ্যান অফ করে উদগ্রীব চোখ রাস্তার দিকে পাঠিয়ে দেই। সম্ভবত আমার গর্ভে জ্বণ এসেছে। গতকাল বাথরুমে উগড়ে গিয়েছিলাম। মইন তুমি ফিরে এসো…..আরও আট বছর তুমি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে বিচিত্র স্বাদের নারী দেবো, তুমি ফিরে এসো। আমি নিজেকে তোমার হাতে খুলে দেবো না, তোমাকেও নেবো না, ফিরে এসো। তুমি শুধু আর্থিক কষ্টে ভুগো, সে জন্য আমিও। কি করার আছে তোমার? সবাই কী কল্পনার মানুষের মতো সার্বিকভাবে সম্পন্ন হয়? আমি একশোবার জানি, নিশ্চিত জানি, অনন্তকাল নারী বলতে তুমি আমাকেই বুঝে। বিট্রে করলে আমিই করি, গোপনে। প্রকাশ্যে কি সম্ভব? মইন, আমরা দুজনেই দ্বিধা এবং বিবেকের কাছে অসহায়। আমি জানি আমাকে স্পর্শ করলেই তুমি জেগে উঠো না। তোমার স্পর্শে আমিও না। তবুও অন্য কোন স্পর্শে আমি জেগে উঠি, প্রকাশ্যে আমরা কেউই তা মেনে নিতে পারি না। সহ্য করতে পারি না। এ জন্য আমরা দুজনই সমান অসহায়।
ঘুম আসে আমার দু’চোখ জুড়ে। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।
১০.
বেশ কিছুক্ষণ পর মইন বুঝতে পারে, তাকে কানাওয়ালায় ধরেছে। ছেঁড়া ধনুকের মতো লাফিয়ে ওঠে সে। কানাওয়ালার ভাবনাটা মাথায় আসতেই স্পষ্ট করে তাকায় চারপাশে। এতক্ষণ কি সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পথ চলেছে? খালি পেটে পাঁচ পেগ পড়ায় নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে? প্রশ্নই আসে না। বিয়ের আগে বহ্বার মেথর পট্টিতে, পিকনিকে গিয়ে খাঁটি বাংলা গিলেছে। দু’বস্ত্র বিভিন্ন কারণে ভালো মানুষটি হয়ে গেছে বলেই পাঁচপেগে দিশেহারা হবে মইন। ছোঃ।
আরে এ কি! মাথা উঠায় মইন, দু’দুটো কাক এক সাথে মরে তারের সাথে ঝুলছে। কি রোমান্টিক মৃত্যু কিন্তু বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার পথে, কখনো তো এই রাস্তায় কাক ঝুলতে দেখেনি। এটা তবে কোন পথ? কোন কোন দিন সন্ধ্যায় বাবা দেরি করে ফিরলে মার ক্রুদ্ধ অথবা চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলতেন, উফ বাবা! কি বিপদেই না পড়েছিলাম। আমাকে কানাওয়ালায় ধরেছিলো। তখন মনে হতো এটা বাবার নিছক একটা অজুহাত। দেরি করে ঘরে ফেরার চতুর একটা অজুহাত।
দুহাতে চোখের পিচুটি ঘষে, সোজা মাথা উঁদ বরাবর খাড়া করে রাজহাঁসের মতো গলা বাড়িয়ে পুনরায় চারপাশে তাকায়। আরে এ কি! রাস্তার পাশেই ছোট্ট একটি মাঠের মতো! মাঠের ওপর সুরকীর স্তূপ, সুরকীর ওপর একটি বিড়াল শুয়ে আছে, অথবা ঘুমোচ্ছ। বাসায় যাওয়ার পথে কখনও তো এক চিলতে খালি জমিনও চোখে পড়েনি তার।
ঘামতে থাকে মইন। মনে পড়ে, একদিন তুমুল বৃষ্টি। কি কড়কড়ে বাজ! এরমধ্যে নিস্তব্ধ রাস্তায় নেমে দেখেছিলো—ক্ষীণ শরীরে, ভিজে জবজবে কাপড় পরা একটি মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে। অফিসের সামনেই। মইন ছিলো সেদিন অফিসের শেষ ব্যক্তি। লোকটির চারপাশে কিছু পয়সা ছড়ানো ছিটানো। কাছে ঝুঁকে মইন দেখেছিলো লোকটির পকেটে একটি ভেজা খাম। আলতো হাতে খুলে ভেজা অস্পষ্ট লেখায় চোখ বুলিয়েছিলো, বাবা, অনেকদিন হয় দেশের বাড়ি আসো না। অফিসের কি অতই ব্যস্ততা যার জন্য….।
মইন লোকটি ভিক্ষুক নয় জেনেই পালিয়ে এসেছিলো। নিচ্ছিদ্র ঘুমে অচেতন হয়তো খুকি। ঘুমিয়ে গেলে খুকি মৃতা নারী। রাতের পথে আর কতক্ষণ ঘুরবে সে? ওইতো ডানের রাস্তা, ওটাই তো…… ভাবতে ভাবতে মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে সামনের দিকে ঝাঁপ দেয় সে। চাঁদের নিজের কাহিল অবস্থা। সে কি পথ দেখাবে? রাস্তার টিমটিমে আলোর ওপর ভরসা করে ডানে ঘুরতেই পায়ের নিচে বিদ্যুৎ খেলে যায়। একটি বিশাল পাথর ছাতলা পড়া দেয়ালের পাশে। বাসা থেকে বেরোনোর সময় অমন বিশালতা চোখে পড়েনি তার। অর্ধেক পোস্টারে ঢাকা ছাতলা পড়া দেয়ালও। তবে কি বামের রাস্তা? কি সব আজব গলি। কালীর মতো লকলকে শুকনো জিভ বের করে রেখেছে। বিপন্ন পা রাস্তার মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে ছেলেবেলার রাজকুমারের মতো মইন বলে ওঠে, পথ, পথ, আমায় বাড়ি নিয়ে চলো।
পথ তাকে নিয়ে চলে। শীরে বাষ্প বেরোনো শরীরকে উত্তুঙ্গ হাওয়ায় সমর্পণ করে ভাবে, কি লাভ বাড়ির খোঁজ করে–খুকি তাকে কতবার ঠেলেছে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য। ঘরে থেকে থেকে সে হাঁপিয়ে তুলেছিলো খুকিকে। আজ সেই সে বোলো। অনেকদিন পর বেরোলো। অন্য রকম বেরোলো। আর কি সে কখনো ঘরে ফিরতে পারবে? পুতুলের লাল নীলের পরে খুকি কি আর কখনো তার সামনে সেই আগের আকর্ষণ নিয়ে দাঁড়াতে পারবে? খুকি ঠেলার আগে সেই কি এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বে না? পথের আনন্দ তো মইনের জানা হয়ে গেছে আজ।
মইনের বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস ওঠে। ঝিমঝিম করছে মাথা। রাস্তার মাঝখানে একটি মুরগি মরে পড়ে আছে। আহ্! আজ শুধু মড়া দেখছি। কি দরকার এমন অভাবের দিনে মুরগিগুলোর মরে যাওয়ার—ভেবে দক্ষিণ গলিতে পা রাখতেই—না, অড় প্রাসাদ আমাদের গলিতে নেই।