অবিন্যস্ত কাপড়ে দৌড়ে যাই। রিসিভারে পৌরুষদীপ্ত আবেগঘন কণ্ঠ আছড়ে পড়ে—কোথায় ছিলিরে খুকি? ফোন ধরতে দেরি হলো? আমি চুপ।
এত ব্যস্ত থাকি! কাজ শেষে আচমকা মনে হয় তোকে। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি তখন।–আমি চুপ।
তোকে শিশু মনে হয় আমার, কখনো কুমারী, মাঝে মাঝে থুথুড়ে বুড়ি। বিশ্বাস কর, তুই বুড়ি হয়ে গেলে তোর সমস্ত চামড়া যখন ঝুলে পড়বে, কুটি কুটি হাঁটবি তুই, তখনো, তখনো, তোকে ভালোবাসবো, এর চেয়ে বেশি বাসবো। আমি চুপ।
আমাকে কবে ডাকবি? তুই-তো জানিস তুই না ডাকলেও আমি যাবো, ছিঁড়ে কুঁড়ে একাকার করবে তোকে। মইন এসে দেখবে তোর সমস্ত চামড়ায়, ভঁজে ভাঁজে হিংস্র আক্রমণ, পাগলের মতো হাতড়ে দেখবে ভেতর থেকে মনটাকে কে যেন খুলে নিয়ে গেছে। আমি চুপ। আমি চুপ! সেই অদৃশ্য পুরুষ আমার সমস্ত অস্তিত্বে তার দীর্ঘ ছায়া ফেলে গভীর কণ্ঠে বলে—আকাশে যাবি? সমুদ্রে যাবি খুকি?
যাবো। যাবো। রিসিভার রেখে দিই। অদ্ভুত ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
৮.
হাঁটতে হাঁটতে মইনের খেয়াল হয়, সে কেবলই হাঁটছে। এত হেঁটেছে এতক্ষণ, অনেকক্ষণ আগেই তো তার বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা, কিন্তু আবছা অন্ধকার গলি, রাস্তার ময়লা, দুপাশের ছোট বড় ঘর বাড়ির চারপাশ দিয়ে কেবলই সে চক্কর খাচ্ছে। তবে কি সে রাজপথ থেকে সোজা গলিতে না ঢুকে পেছন দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আসা জটিল গলিটায় ঢুকে গিয়েছিলো?
যাক বাবা! ভালোই হয়েছে সোজা গলিতে তো রোজই ঢুকি। আজ না হয় জটিল পথেই ঘুরলাম–ভাবতে ভাবতে শিস দিয়ে ওঠে মইন।
গতকাল রাতে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলো সে। সারাদিন পর এখনই স্বপ্নটির কথা মনে পড়ে তার। ভোরেও একবার হয়েছিলো। স্বপ্নটি ছিলো এমন–দরজায় টুকটুক শব্দ হচ্ছে। দরজা খুলেই বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে উঠলো। এলোমেলো ক্লান্ত পায়ে যে পুরুষটি তার ঘরে এসে ঢুকলেন, তিনি তার বাবা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সমস্ত কপালে ঘিনঘিনে ঘাম। শরীরে আঁশটে গন্ধ। তিনি থলেটা মাটিতে নামিয়ে রেখে কষ্ট করে শ্বাস টানতে থাকেন। লোকটিকে গতকালই সে বিছানায় লেপটে থাকা অবস্থায় দেখে এসেছিলো। মইনের কাঁধে সারা শরীর ভর করে দাঁড়াতে পারছিলেন না। থরথর কম্পনের সাথে বিছানায় পতিত হয়েছিলেন। অনড় ডান পা, ডান হাতকে সজোরে নিজের আয়ত্ত্বে আনার আপ্রাণ চেষ্টার পর হতাশায় শক্ত সামর্থ মানুষটির চোখে জল এসে গিয়েছিলো।
এখন তাকে শিশুর মতো টলমনে ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকতে দেখে বোবা হয়ে গেলো সে।
গতকাল কুমিল্লায় বাবাকে দেখতে গিয়ে তার মিনমিনে কণ্ঠস্বর মার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়েছিলো সে, একবার ফিজিওথেরাপী করে দেখলে হতো।
বাবার শরীর বিছানায় আড়াআড়ি শোয়ানো। তার একটি পা-কে সজোরে নেড়ে চেড়ে এক্সারসাইজ করাতে করাতে ভগ্ন কণ্ঠে মা বলেছিলো, ওরা তো দিনে ষাট টাকা করে নেয়।
পালিয়ে এসেছিলো মইন।
স্বপ্নেও বাবাকে হেঁটে আসতে দেখে তার আগের দিন কুমিল্লায় যাওয়া, ফিজিওথেরাপী, পালিয়ে আসা সব মনে পড়ে গিয়েছিলো।
ঘুম থেকে উঠে দেখেছিলো অর্ধ বিবস্ত্র খুকি ঘুমিয়ে আছে। উত্তপ্ত দেয়াল ধরে অতি সন্তর্পণে অগ্রসরমান টিকটিকি বার বার তার অসহায় লেজ ওপর দিকে উঠাচ্ছে। জানালা দিয়ে থুথু ফেলতে গিয়ে নিচে পুড়ে যেতে থাকা ফলশা গাছের দিকে চেয়ে একবারই মাত্র স্বপ্নের কথা মনে হয়েছিলো। সারাদিনের ঘোরের পর এখন আরেকবার।
আমি কি? নিজেকে মইন প্রশ্ন করে হা হা করে হেসে ওঠে, আমি হলাম বুদ বুদ…রঙ ধনু…আর কি? আর কি?
৯.
আবদুল্লাহর সাথে খুব মজার সম্পর্ক আমার। পত্রিকা অফিসের রিপোর্টার সে। যদি জিজ্ঞেস করি, কেমন আছো হে? আস্তিন গুটিয়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলবে—স্বামীর ব্যাভিচারের দরুণ স্ত্রী তাহাকে ক্ষুব্ধ হইয়া এসিড ছুঁড়িলে সে যেমন থাকে—তেমন।
আমার ভাবনার খবর সে জানে। পত্রিকার খবর নিয়ে বেশি ভাবি, সেটাও জানে। ফলে প্রায়ই তার সাথে আমার কথা হয় এমন—
আমি জানো, আজকের পেপারে পড়লাম, নয় মাসের গর্ভবতী এক পাগলিনীকে একদল ছেলে জোরপূর্বক….।
আবদুল্লাহ্ আহা! তুমি যদি সেই পাগলিনীটি হইতে?
আমি না ঠাট্টা নয়, কি যে হচ্ছে চারপাশে। আরেকটা নিউজ পড়ে তো সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম! অভাব সহ্য করতে না পেরে এক বাবা তার চার সন্তানকে বিষ খাইয়ে।
আবদুল্লাহ–আহা থামো! থামো। আমি যাহা জানি তাহা ইহার চাইতেও অধিক পৈশাচিক। এক বৃদ্ধ পিতাকে খুঁটির সাথে বাঁধিয়া তাহার সামনে রোজ রাতে একদল ছেলে তার বাবা মেয়েকে।
আমি–থাক্ থাক্। ভাল লাগে না।
আশ্চর্য! কি করে এই সব প্রসঙ্গের পর আবদুল্লাহ্ ঘোর লাগা চোখে তাকায়? বলে খুকি, তোমার অনুভব, সচেতনতা খুব সুন্দর, এই জন্যই, এই জন্যই আমি…?
ছিটকে ঘরে আসি আমি। পৃথিবীটা আমার কাছে বীভৎস হয়ে ওঠে।
আজ চন্দ্রগ্রহণ গেলো। জানালা দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখেছি একটি ছায়া একটি চাঁদকে গ্রাস করছে। গ্রাস করছে মনে হতেই আমার শরীরের রোম দাঁড়িয়ে যায়। আজ রাতে যখন অন্ধকারে মইন আমাকে খুঁজতে থাকবে, বিয়ের প্রথম দিকের সংস্কার, বিবেকবোধের পাছায় লাথি দিয়ে কি মহেন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানাবো? তুমি আমাকে গ্রাস করো। গ্রাস করো! আট বছর ধরে মইনকে অনেক বিচিত্র স্বাদের নারী উপহার দিয়েছি। বড় ক্লান্তি লাগে। বিচ্ছিরি লাগে। অবসন্ন লাগে। আমার ফের শীতল হয়ে উঠতে থাকা শরীরে মইন যদি আবার ক্রুদ্ধ হয়? বিরক্তি প্রদর্শন করে?