যা হোক, কথা হচ্ছিলো ভাবনা নিয়ে। কত কিছু যে ভাবি আমি! রাতের স্বপ্নকে নিয়ে ভাবি, জানালায় নির্জন চোখ রেখে ঘুমন্ত শহরকে নিয়ে আমি ভাবি, কোনদিনই এক টুকরো জমি কেনা হবে না, ভাবি। একঘেয়ে একটি জীবনকে আজীবন টেনে নিয়ে যেতে হবে, ভাবি। ইরফান, মহেন্দ্র অথবা আবদুন্নাহ তিনজনের একজন আমার কর হলে কেমন হতো, ভাবি।
ভাবনার সবচেয়ে দুঃসহ, জঘন্য, আনন্দদায়ক, মৌলিক প্রয়োগ আমি আমার শরীরে ঘটাচ্ছি। খুব আশ্চর্যজনক ভাবে বিয়ের একমাস পর থেকেই আমি একটি নিরুত্তাপ শীতল মানুষ। তখন মইন ছিলো ঝড়ের মতো। অত শীতলতার পাশাপাশি সে-ই বা কেন স্বাভাবিক ভালো মানুষটি থাকবে? প্রথম কদিন ভালোমানুষী করলেও শেষে খেপে উঠতে থাকলো। তখন আমার দাদিকে ব্যাপারটা খুলে বললাম। পুরুষদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল দাদি এক ভীতিকর সংবাদ দিলেন আমাকে। বেশিদিন যদি আমি মইনকে এমন শীতলতা দেখাই তবে মইন অন্য নারীতে আসক্ত হবে। ঈর্ষাষিত হয়ে উঠি এবং চিন্তিত হয়ে পড়ি আমি। আমার সেই নাজুক মুহূর্তে ভানা আমাকে বিচিত্রভাবে সহায়তা করে।
আমি উপলব্ধি করি, যখন থেকে মইন আমার কাছে নিতাই শাদামাটা একজন মানুষ হয়ে গেছে, তখন থেকেই তাকে কেন্দ্র করে আমার শরীরের রঙ্গগুলি উবে যাচ্ছে। এই চিজ একবার গেলে আর কি ফেরে? তো অসুখের কারণ তো সনাক্ত করা গেলো। চিকিৎসা? প্রথমেই ভাবি, বাতি নিভিয়ে আমি মইনকে অন্য একটি পুরুষ হিসেবে গ্রহণ করবো। কিন্তু ওই যে বিবেক সংস্কার যেটা আমাকে কিছুদূর সামনে এগোতে দিয়ে টান দিয়ে পেছনে নিয়ে যায়। তার তাড়নাই আমাকে বলে দিলো, এতে করে মইনের সাথে প্রতারণা করা হবে। অন্তত যতদিন দুজন একসাথে আছি, কিছু দায়বদ্ধতা তো আছে। এছাড়াও ধর্ম? আমার পাপ হবে না?
কি করা যায়! ভাবতে ভাবতে একসময় আমি এক নতুন খেলা আবিষ্কার করে ফেলি। সেদিন রাতেই মইনকে বলি, এখন থেকে দুজন অন্ধকারে ঘুমোবো। কোন আলো থাকবে না, একদম কুচকুচে অন্ধকারে। আলো থাকা না থাকায় মইনের কিছু যায় আসে না। আমার প্রতিটি ভজ, রহস্য বই তার চেনা। আমি কি টের পাই না কি অবলীলায় সে আমার সব কিছু ছোঁয়?
শুরু হলো প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন। একরাতে সমস্ত ঘরে ঘোর অন্ধকার। জানলা গলিয়ে এক চিলতে আলো আসছে কি আসছে না। আমি মইনকে বলি—আজ একটু সময়ে নেবো।
নাও রাজকন্যে নাও। আমি চোখ বুজে ভাবতে শুরু করি, আমি খুকি নই, অন্য একটি সুন্দরী রমণী। খুকি ওর বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তখন খুকিরই এক আত্মীয়া বেড়াতে এসেছে খুকির বাসায় তখন মইন একা। সুন্দরী আত্মীয়া রাত কাটাতে চাইলো। মইন তাকে সানন্দে থাকতে বললো। শেষ রাত। সুন্দরী তখন ঘুমোচ্ছে। মইন ওর রুম ছেড়ে সুন্দরীর রুমে চলে এলো। মইনের বিল সুন্দরী তখন কেবলই অস্ফুট কণ্ঠে নানা করছে।
তো এই ভাবনার পর মুহূর্তেই আমি খুকির খোলস ছেড়ে সেই সুন্দরীটির ভেতরে চলে যাই। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে অনুভব করি, আমি জেগে উঠছি। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আমার সমস্ত শীতলতা রূপ নিচ্ছে এক গনগনে আগুনে, যা আমি হারাতে বসেছিলাম।
মইনের তারপর কি আনন্দ। উফ, কি ফ্রাস্টেটেড হয়ে পড়েছিলাম তোমাকে নিয়ে। এদ্দিন কি তবে ইচ্ছে করেই অমন শীতল থেকেছো? হেই খুকি! অন্ধকারে তখন অমন না না করছিলে কেন?
এভাবেই শুরু? সারাদিনের অন্য ভাবনার মধ্যে দিয়েও আমি স্থির করে রাখতাম, আজ আমি কোন রমণী হবো। আমার ঘরটি কোন ঘর হবে।
অন্যদিন তেমনই ঘর অন্ধকার। শরীরে পাউডার ছড়িয়ে ভাবি, আমি একটি বিদেশী রমণী। অফিসের সোর্সে মইন লজ্ঞ এসেছে। তো বিদেশিনী তাকে তার রুমে রাত কাটানোর জন্য সাদর আহ্বান জানাচ্ছে। খুকির কথা ভেবে ইতস্তত করছে মইন। কিন্তু বিদেশিনীর আকর্ষণীয় শরীর, ভঙ্গির কাছে এক সময় মইনের দ্বিধা টেকে না। খুকী জানলে কি যে কষ্ট পাবে, আমার নিচে ফোমের শয্যা। অন্ধকার ঘরে দামি আসবাব। খুকি জানলে কি যে কষ্ট পাবে, ভাবতে ভাবতে দোদুল্যমান মইন সেই আকর্ষণীয় গন্ধের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। সবুজ আলো নেই, একবিন্দু আলো নেই, গভীর গভীর অন্ধকারে খুকির খোলস ছেড়ে বিদেশিনীটি হয়ে আমি জেগে উঠি….জেগে উঠি। আমাকে কেন্দ্র করে মইনের ক্রোধ, দুশ্চিন্তার, অপূর্ণতার অবসান হয়।
কিন্তু কখনো বিদেশিনী, কখনো বারবণিতা, কখনো প্রতিবেশিনী, সুন্দরী আত্মীয়া, সমুদ্রের কাছের ডাক বাংলাতে পরিচয় হওয়া পরিচিত-আট বছর যাবত অতসব ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে আমার একঘেয়ে শরীর, একঘেয়ে মন, কষ্টার্জিত ভাবনা, ক্রমেই নেতিয়ে পড়ছে, ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, শীতল হয়ে পড়ছে।
কিন্তু বাঁচতে হবে বলেই একসময় সেই গভীর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আমি সূর্যালোকে মাথা সোজা রেখে দাঁড়াই। ভাবনার আরেকটি সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর অধ্যায় আমাকে টেনে বাইরে আনে। সেই অধ্যায়টি আমার একজন স্বপ্নের পুরুষকে কেন্দ্র করে। যার পূর্ণাঙ্গ একটা রূপ সম্পর্কে আমি বর্ণনা দিতে পারি, কিন্তু যাকে আমি এই জীবনে দেখিনি। এই একটি মানুষকেই যতটুকু সম্ভব দ্বিধাহীন ভালোবাসি আমি। জল স্থল অন্তরীক্ষে আমার স্বপ্নের টেলিফোন বেজে ওঠে ক্রিং ক্রিং। সে ভরাট কণ্ঠে আমাকে ডাকতে থাকে…খুকি….খুকি।