উফ কি সোভার লাগে আপনাকে বলতে বলতে কি মাথা নোয়াতে পারতো?
ঘরে ঢোকার পর হাঁটুর ওপর লুঙ্গি-পরে শার্টটাও ছুঁড়ে ফেলে সোফায় গা এলাতে এলাতে খুকির বিরক্তিকর চেহারার দিকে চেয়ে কখনও কি তার মনে হয়েছে খুকি ওর প্রেমিকা, স্ত্রী? ওর সামনেও অতটা অকৃত্রিম হওয়া ঠিক না, যতটুকু সে নিজের সামনে একা হতে পারে? কখনই মনে হয়নি। কেননা খুকিকে সব সময়ই ওর মা অথবা বড় আপা গোত্নে গার্জিয়ান মনে হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে শিশু। গার্জিয়ান বা শিশুর সামনে অত ফর্মাল থাকার দরকারটা কী?
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অত্যন্ত জরুরিভাবে সকালে পড়া নিউজটা মনে পড়ে। আজ বৃহস্পতিবার চন্দ্রগ্রহণ। সন্ধ্যা ৭টা ৪৩ মিনিটের কয়েক মুহূর্ত পর ৫ ঘণ্টা স্থায়ী চন্দ্রগ্রহণ শুরু হইবে। চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় আহার হইতে বিরত থাকার রেওয়াজ আবহমানকাল ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে।
আবহমানকালকে অস্বীকার করার মতো অত শক্তি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মইন সঞ্চয় করতে পারেনি। সূর্যকে যেমন কপালে হারে ছাউনী দিয়ে দেখতে হয়, চাঁদকে দেখার জন্যও তেমনই মইনের অবচেতন হাত কপালে উঠে যায়। আকাশের মাঝখানে থ্যা, উচ্ছিষ্ট, ধর্ষিতা চাদ। কতক্ষণ আগে কি ধকলটাই না গেছে বেচারির ওপর দিয়ে। ভীষণ নির্জন চারপাশ। চাঁদ আজ ছুটি নিয়েছে, পড়ন্ত রাত্রে রাস্তার বা বড় অসহায় করে তুলেছে রাতকে। হাঁটতে হাঁটতে বাঁয়ের গলিতে ঢুকতেই আবার চন্দ্রগ্রহণের কথা মনে পড়ে। পিরিয়ড শুরু হওয়ার ডেট থেকে আরও পনেরো দিন পেরিয়ে গেছে খুকির। মাঝে মাঝেই এমন যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছুটা বিরতির পর পিরিয়ড শুরু হলে অঝোর হয়ে কেঁদেছে খুকি। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। ইলিশ মাছ খুব প্রিয় খুকির। সেটা খেতে গিয়ে গতকাল দুপুরে উগড়ে দিয়েছিলো সে। ফলে পাটিতে বসে দুজন দুজনের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়েছিলো। নিরুত্তাপ গলায় খুকি ঘরের দেয়ালকেই বকেছিলো, মইনের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে, আমি অত তাড়াতাড়ি আর খুশি হচ্ছি না। তরল গলায় মইন বলেছিলো, এবার মিস গেলে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলবো না! খুকি বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকাতেই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিলো–আরে তোমাকে না, তোমাকে না, ঋতুস্রাবকে।
চন্দ্রগ্রহণের সময় খুকি যদি আহার গ্রহণ করে থাকে? কিছুটা বিচলিত মইন রাস্তার ওপর ছড়িয়ে থাকা গন্ধযুক্ত উচ্ছিষ্টের ওপর দিয়ে দপ দপ পা ফেলে হাঁটে। ঢেকুর তুলে ভ্রু কুঁচকায়, খুকিটার তো জীবনেও ও চন্দ্রগ্রহণ টহন মনে থাকার কথা না। সারাদিন সে ফার্ণিচার এদিক সেদিন করবে, না ওসব দিকে খেয়াল দেবে। আশ্চর্য মেয়ে ও। গম্ভীরভাবে চিন্ত করে দেখে মইন, স্ব উপকরণ থাকা সত্ত্বেও শুধু ওর স্ত্রী হওয়ার কারণে রহস্যময়ী হয়ে উঠতে পারলো না। আচ্ছা চিজ বটে একখানা!
৭.
আমার নাম ভাবনা হলে বেশ হতো। আমি সারাদিন ভাবি। ঘুম থেকে ওঠে প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় মৃত্যু সংবাদ খুঁটে খুঁটে পড়ি। যে বাসার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আমার সারাদিনের ভাবনায় তারা প্রত্যেকেই জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাদের জায়গায় আমি নিজেকে স্থাপন করি। ভাবি, মইন ঘর থেকে বেরিয়ে যদি আর না ফেরে? এক সময় এই ভাবনাও আমাকে রোমাঞ্চিত করে। তাহলে সারাজীবন একজনের সাথে একঘেয়ে জীবন যাপনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি! কেউ কোন দোষ দেবে না, উল্টো সহানুভূতি! কিছুক্ষণ পরই অস্তিত্ব সংকটে শিউরে উঠি, এসব কি ভাবছি আমি? কারও সাথে কোন সাধারণ কথা হলে অতি ব্যস্ততায়ও সেই কথোপকথন আমার কানে বারবার বাজতে থাকে। এইতো সেদিন কে যেন বললো— চাকরিটা ছেড়েই দেবো ভাবছি। চাকরি ছিলো না, সে এক ভালো ছিলাম। কিন্তু চার বছর স্যান্ডেলের তলা খুইয়ে যা-ও একটা গতি হলো, মা বাবা, ভাইবোন সারাদিন এটা চাই, ওটা চাই। তিন পয়সার একটা চাকরি আমাকে রাজহাঁস বানিয়ে ফেলেছে, সংসারে একশোটা ফুটো রাজহাঁস ডিম দাও….. ডিম দাও…..
কে যে কথাগুলো বলেছে, কোথায় বলেছে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে ভেবেও হদিস পাইনি। চাকরি যারা করে, সম্ভাব্য সবার কথাই ভেবেছি। খুঁজে পাইনি। প্রতিবেশীর সাথে, টিভি প্রোগ্রাম, শাড়ি কেনা, কাজের মানুষ রাখার ঝকমারি, ইত্যাদি আড্ডা দেয়ার সময় কাপড়ে সুই ঢোকানোর সময়, বাথরুম ঝাট দিতে দিতে, চা পাতার খালি কৌটো বাড়তে বাড়তে বারবার সেই কথাগুলো কানের কাছে চক্কর খেয়েছে। আমার এই এক মহাজ্বালা! সেদিন এক বিয়ের আসরে ঘর্মাক্ত মইন বললো— কি বিশ্রী রোদ উঠেছে। বাসায় আসার প্র এই কথাটিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাজারবার ভেবেছিল কি বিশ্রী রোদ উঠেছে।
সেই ভানায় বিশ্রী শব্দটা আমার ভেত্র এমনভাবে গেঁথে যায়, আগে যেটা নিয়ে শুধু ভাবতামই, বলতাম না। তাই মাঝে মাঝে বিশ্রী শব্দকে মাঝে রেখে বলতে শুরু করলাম। যেমন, মইন যখন এক ঠ্যাং সোফায় তুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে একমনে নাক পরিষ্কার করতে থাকে। টেলিভিশনে হয়তো তখন একটা সুন্দর শাদাকালো অনুষ্ঠান চলছে। আমি হকচকিয়ে বলে উঠি কি বিশ্রী অবস্থা! বিয়ের আগেই আসলে ভালো ছিলো। মইনের ওপর সমস্ত খারাপ লাগা ঝেড়ে দিই। মইনের নাকে আঙ্গুল বহাল থাকে, আধবোজা চোখ মেলে জিজ্ঞেস করে টিভি প্রোগ্রামের সাতে বিয়ের আগের অবস্থার সম্পর্ক কি? অথবা ওর খুঁড়ি প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে ক্রমেই বিশাল হচ্ছে, কারেন্ট চলে গেলে যখন হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে আমি ভৎর্সনা করি, পই পই করে বলি খাওয়াটা কমাও, নয়তো এক্সারসাইজ করো। তা করবে না। দিনদিন ডোম্বলদাস হয়ে দেখি কারও জ্ঞান হচ্ছে না।