বিচিত্র ভঙ্গিতে ভূমণ্ডলের চারপাশে তর্জনী ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে পুতুল। তুমি খেলবে! ওহ গড! ফেনটাসটিক! কি যে একটা হোপলেসকে বিয়ে করেছিলাম। যাক শালা! চুকিয়ে বুকিয়ে ফেলেছি…..এই এই আমি লুকোচ্ছি, তুমি চোখ বোঁজো।
মইন চোখ বুজতেই রংচঙে আলোর শাঁসালো অন্ধকার ওর চোখ বিদ্ধ করে।
কুউউ…. কোকিলের মোন ডেকে ওঠে পুতুল।
সন্তর্পণে চোখ মেলে সমস্ত ঘরে দপদপ পা ফেলে মইন হাঁটে। খাটের পেছনে পুতুলের গোলাপি শাড়ি দেখা যাচ্ছে! কি শিশু মেয়েটা! ভাবতে ভাবতে খপ করে সে ওকে ধরতে যায়। হি হি করে দৌড় দিয়ে গিয়ে পুতুল হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
মইন দেখে লাল আলো, নীল আলো, হলুদ আলো…ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর, পেয়েছি, পেয়েছি বলে। কি আশ্চর্য ভিবজিওর। পুতুল ক্রমশ অপ্সরা, ক্রমশ পৃথিবীর প্রথম নারী, যে পোশাককে অশ্লীল করে তোলে…..।
একটা গর্তের মধ্যে পা হড়কে পড়ে যায় মইন। চারপাশে তাকিয়ে কাপড় ঝেড়ে দাঁড়ায়। কিছুটা চোট লেগেছে পায়ে। মুশকিল হলো! দরজা খুলে খুকি হা হা। করে উঠবে না তো! একেবারে বিনা নোটিশে দুপুর থেকে হাওয়া সে।
হায় মইন! তুমি গিলে এসেছে! কোথায়….কার সাথে? নাহ এই মুহূর্তে খুকীকে ভাবতে ভালো লাগছে না।
৫.
চারপাসে শুধু চোখ দেখি। কি যে বিচিত্র সেসব চোখের আকৃতি। যেমন,
(ক) কাঙাল চোখ বাথরুমে, শাওয়ারের নিচে ডুবে যখন উদোম স্নানে ব্যস্ত থাকি, তখন চারপাশের দেয়ালে অনেকগুলো চোখকে কাঙালের মতো চেয়ে থাকতে দেখি। যাদের অনেকেই আমার পুরনো প্রেমিক অথবা একতরফা ভালোবেসেছে। আমাকে। তাদের প্রতি আমার সহানুভূতি ছিলো কিন্তু প্রশ্রয় ছিলো না।
(খ) কঠিন চোখ— মহেন্দ্র অথবা ইরফান অথবা আবদুল্লাহ ওদের একজন, ধরলাম মহেন্দ্ৰই, সোফায় বসে আমার সাথে বিভিন্ন আলাপে ব্যস্ত নানা এটা ঠিক না খুকি, রিকশা ভাড়ার ভয়ে তোমরা হলিডেগুলোতেও অন্তত কোথাও তেমন বেড়াতে যাওনা, এরকম একঘেয়ে জীবনে কেউ বাঁচতে পারে? তুমি রীতিমতো অনার্স গ্র্যাজুয়েট মেয়ে, শশুর শাশুড়ী চায় না বলেই চাকুরি করবে না, মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে, মইন এটা খুব অন্যায় করছে….তারপর ক্রমে ক্রমে নিজের হতাশার অতলান্তে তলিয়ে যেতে যেতে, তোমাকেই বা কী বলবো খুকি, জীবনের এতগুলো বছর চলে গেলো, কোন চাকুরিতে স্থির হতে পারলাম না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমিই পলিটিক্সের শিরা হয়ে যাই। ভেরেন্ডা বাজানো ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছুই হবে ….কিছুই হবে না….এরকম একটা হতাশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আমার হাতটিকে টেনে নেয় নিজের কম্পিত হাতের মুঠোয়, একমাত্র তোমরা এখানে এলে তোমার এখানে এলে…বলতে বলতে মহেন্দ্র যখন আমার নির্জন বাড়িটিতে আরও কিছুটা এগোতে চায়, তখনই মইনের দুটি কঠিন চোখ দরজা ফাঁক করে আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি এত্ত ভঙ্গিতে সরে যাইছি, ছি, ও আমাকে একদিনের জন্যও ফাঁকি দেয় না, অথচ আমি…।
(গ) নিষ্পাপ চোখ-—এই চোখ দুটোই আমাকে বেশি বিপন্ন করে তোলে। সেই চোখ আমার পরম আকাঙ্খিত শিশুটির। কি অদ্ভুত মায়াময় চাউনি। স্তন মুখে নিয়ে, ক্রন্দনরত অবস্থায়..কত বিচিত্র ভাবেইনা সেই চোখ আমাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। জানালা গলিয়ে যখন ইউক্যালিপ্টাস গাছে বাতাস শরীরে আছড়ে পড়ে, তখনই বুকের কাছে সেই চোখ নড়ে চড়ে ওঠে। ড্রয়িং রুমে হয়তো মইন পত্রিকার প্রতিটি অক্ষর খুঁটে খুঁটে পড়ছে। আমি উনুনে হালুয়া চড়িয়েছি: তিন নম্বর ছোট প্লেটটি শূন্য চোখে আমার দিকে তাকাতেই জল আসে আমার চোখে। এরকম ছোট ছোট অনেক জিনিস কিনেছি আশ্চর্য এক শূন্য অনুভব থেকে।
৬.
সকাল বেলা অফিসে যাওয়ার সময় মইনকে বগুলো জরুরি কাজের কথাই জরুরি ভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিলো খুকি। সারা রাস্তা দাদখানি চাল, মুশুরের ডাল, চিনিপাতা দই….করতে করতে অফিসে যেতেই তালগোল পাকিয়ে গেলো। গতকালই মাত্র অতসীকে সে বলেছে ‘নীল শাড়ি আমার খুব ফেভারিট’, ধবধবে অতসী আজই নীলাম্বরী হয়ে ফর্শা আঙ্গুলের ফাঁকে কলমটিকে চেপে ধরে উবু হয়ে কি সব লিখছে। শুধু অতসী দেখবে বলেই বাসায় গেঁয়ো ভূত হয়ে থাকা মইন ফিটফাট হয়ে অফিসে আসে। নীল শাড়ির অতসীর, ফর্শা আঙ্গুলের চাপের কলমটি যদি আমিই হতাম, যদি…..তখনই দাদখানি চাল, ডাল হয়ে গেলো, চিনিপাতা দই, কই হয়ে গেলো, মুশুরের ডাল, চাল হয়ে গেলো।
তারপর ঝা ঝা রোদে বহুদিন পর সবুজাভ, হলুদাভ, নীল, গোলাপি মার্সিডিজের আহ্বান। খুকির সাথে বিয়ের পর আজকের দিনটাই একটু বেশি বেহিসাবী খরচ হয়ে গেলো। এতটা পাতালে, অতলান্তে, গভীরতায়—মইন ঘুমের মধ্যে কখনও অমন স্বপ্ন দেখেনি। যে খুকির শরীরে হাত রাখলে প্রতিদিনই তার মনে হয়েছে-সৃষ্টিকর্তা এ-কি আজব বিষয় সৃষ্টি করলেন, হাজার ব্যবহারেও যার ক্ষয় হয় না, সেই খুকির মাংসও আজ ফোমে পরিণত হয়েছে। মইন স্বপ্নের এক একটি স্তর অতিক্রম করেছে আর উপলব্ধি করেছে, জীবনে আজই প্রথম সে সত্যিকার পুরুষ হয়েছে। আজই প্রথম সে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছে।
নিদিন যাবত ওদের ফ্ল্যাটে পানি নেই। দুটোর সময় ঘরে ফিরলে খুকির-অসহ্য হয়ে উঠেছে জীন, আচ্ছা রান্না, থালাবাসন ধোয়া না হয় এক চিমটি জলে সারলাম। কিন্তু স্নান? একটু যাও নাগো, নিচের কলে—এই সবের পরে সন্ধ্যায় মইন মাসুদ রানা থেকে মুখ তুলতো। তারপর লুঙ্গিটাকে হাঁটুর ওপর উঠিয়ে থলথলে উঁড়ি নাড়তে নাড়তে দু’বালতি জল নিয়ে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে আচমকা ভাবতো— অতসী যদি এই অবস্থায় আমাকে দেখে?