মইনের কারণেই আসলে ধীরে ধীরে আমার ভেল্প আলাদা ঘরের স্বপ্ন আসন গেড়ে বসেছে। দুটোর সময় অফিস থেকে ফিরে সে ঘরের মধ্যে শেকড় ছড়ানো গাছ হয়ে। যায়। পই পই করে বলে দেখেছি, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসো, ফ্রেশ লাগবে, যাবে না।
যাবে না, ভালো কথা, কিন্তু সময় কাটানোর জন্য অথবা ড্রেসিং টেবিল হাতড়ে পুরোনো টাই ক্লিপ খোঁজাখুঁজি করা কেন? নির্দিষ্ট ম্যাগাজিনের খোঁজে তোষক উল্টে পাল্টে একাকার করা কেন? ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার ছাড়া, তোষকের নিচ ছাড়া আমি আমার এই ছোট্ট দুই রুমের কোথায় আমার গোপন জিনিসগুলো রাখি? ওগুলোর একটি কণাও যদি মইনের চোখে পড়ে আমি কি ওর ক্রোধকে কম চিনি? প্রথমেই তার বিশ্রী ভয়াবহরূপ প্রদর্শন করার পর খুব ঠাণ্ডা অথচ স্পষ্ট গলায় বলে উঠবে না—এর পরে আর আমাদের এক সাথে থাকা চলে না!
যাতে ও এই ঘরের সমস্ত আসবাব পত্রের মতোই নিরাপদ শান্তটি হয়ে থাকে, সেই জন্যেই আমার একটি আলাদা ঘর দরকার। সেই শূণ্য ঘরে থাকবে একটিই মাত্র চেষ্টঅবড্রয়ার, যেখানে আমি আমার পুরোনো প্রেমিকদের দেয়া চিঠি, ডাইরী, চমৎকার ভাষায় প্রেজেন্ট করা বই, ওদের সাথে ভোলা আমার কিছু ছবি, এখনকার লেখা প্রাণপনে লুকিয়ে রাখা ডাইরীটি সব সযত্নে রাখতে পারি। এই জিনিসগুলিই আমি আমার এক ব্যাচেলার বান্ধবীর কাছে রেখেছি, যদিও সে বলেছিলো, এগুলো পুড়িয়ে ফেলতে, সংসারের জন্য এইসব বিষয় অত্যন্ত বিপদজনক! কিন্তু আশ্চর্য স্মৃতিকাতর মেয়ে আমি কিছুতেই এসব বিষয় ধ্বংস করার কথা ভাবতে পারি না। সেদিন মইনের ছেলেবেলার বন্ধু মহেন্দ্র একটি বড় এ্যালবাম প্রেজেন্ট করেছে। আমাকে। এত চমৎকার সেটা, দেখেই ভালোলাগায় উছলে উঠেছিলাম। কিন্তু খুলেই কি বিব্রতকর অবস্থা! একদম কোণায় লেখা পরকীয়া প্রেমে পাপ নেই। কৈশোর। পেরোবার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি আমার প্রেমিকদের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল, সে যদি রাস্তার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা উদাস ভিখিরিটিও হয় আমার কাছে তার প্রেমই বড়। কেননা সেই প্রেম আমাকে কেন্দ্র করে। আমি সবচাইতে আমাকেই যে ভালোবাসি।
আমি কলেজে পড়বার সময় থেকেই হেমিংওয়ে, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এসব লেখকের পাঠক হিসেবে ক্লাসমেটদের অমিতাভ, মিঠুন চক্রবর্তীর আড্ডা থেকে নিজেকে আলাদা ভাবতাম। যখন কোন স্ত্রী অন্যের হাত ধরে পালিয়ে গেছে শুনে সমস্ত পাড়ায় ছিঃ ছিঃ চলছে তখন আমি এ থেকে খুঁজে খুঁজে বের করতাম এর পক্ষের কোন যুক্তি। এক সময় স্থির হতাম এই ভেবে—যদি হাসব্যান্ডের সাথে আন্ডারস্ট্যান্ডিং না-ই হবে, তবে আর সমস্ত জীবন ধরে তার সংসার টেনে লাভ কী? গেছে, ভালোই করেছে। যাহোক, কথা হচ্ছিলো এ্যালবাম নিয়ে। এ্যালবামের কোণার লেখাঁটি বিব্রতকর হলেও মইনের ভয়ে কেটে ফেলতে এক কষ্ট হলো আমার, মনে হলো, আমার কোন ব্যক্তিস্বত্ত্বা নেই। আমার নিজস্ব কোন জিনিস থাকতে নেই। এইসব বিষয় থেকেই সেই হাওয়া ঘর আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। সেই ঘরে শুধু একটিই চেস্টঅবড্রয়ার থাকবে এবং তার শুধু একটিই চাবি থাকবে…..।
৪.
ফোমের শয্যায় গোলাপি শাড়ির পুতুল আলতো ভঙ্গিতে শুয়েছিলো। পুতুলকে ওই অবস্থায় দেখে মুহূর্তেই নিজের ঘরের মলিন, দরিদ্র ছাতলা পড়া ঘরে কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো মইনের। নিজের ঘরে এতদিন কড়কড়ে সুতির শাড়ি পরিহিতা খুকিকে বেশ টিপটপ লাগতো। গোলাপি শয্যার গোলাপি পুতুলকে দেখে মনে হয় কী শিশু ছিলাম এতদিন! এতদিন কি সে শুধু খুকীর রক্তমাংস স্পর্শ করার বদলে একদলা ফোম ঘেটেছে? তার সহপাঠিনী পুতুল দশ বছর আগের চেয়েও স্বপ্নময়। বিছানায় গা এলিয়ে ঝকঝকে গ্লাসে রঙিন তরল ঢেলে একটু একটু খাচ্ছে আর অদ্ভুত চোখে মইনকে দেখছে তোমাকে দেখে বেশ হেপী মনে হয় মইন, আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে তুমি—গুল মারতেও শিখে গেছে দেখছি, প্রিন্টের সোফায় মইনের শরীর এলিয়ে পড়ে, ভূঁড়িটা বেড়ে গেছে চোখে পড়ছে না?
আগে তো টিং টিঙে কলাগাছটি ছিলে, ওই ভূড়িটায় তোমাকে মানাচ্ছে বেশ।
ভূঁড়িতে মানাচ্ছে। মইন কি হাসবে? কি আজব পুতুল! ওর শরীর থেকে কামিনী ফুলের গন্ধ আসছে। মইনের ঘোর লাগতে থাকে ওর সমস্ত শরীর কি নূপুর দিয়ে মোড়ানো? একটু নড়লেই অমন ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে যে! ঘাড়ের কাছে পড়ে থাকা ছোট্ট চুল ঝাঁকায় সে, মনে আছে, আমি যখন প্রথম গাড়ি থেকে নেমেছিলাম তুমি হ্যাংলার মতো বার্সিটির গেটে?
মনে আছে, সব….সব। একদিন কাতুকুতু দেয়ার ছলে তোমার বুকে….।
স্টপ! স্টপ! জোর প্রতিবাদে থামিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু হাসির দমকে পুতুলের গোলাপি শাড়ি, গোলাপি ঠোঁট, গোলাপি ব্লাউজ, গোলাপি মাংস…সমস্ত গোলাপি থর থর করে কেঁপে ওঠে।
ছাদের দিকে তাকায় মইন, ঝাড়বাতি নয়, মহানাগরিক সূর্যকিরণ পুতুলের ঝলমলে গোলাপিতে আছড়ে পড়েছে। অনেকদিন প্র জিপেগ গিলেই এক মহাচত্রের মধ্যে পড়ে যায় সে। পুতুল হঠাৎ দাঁড়ায়, জানো, অনেক বড় হয়েও আমি বাবার সাথে লুকোচুরি খেলেছি, বাবা লুকিয়ে থাকতো আমি খুঁজে বের করতাম, অথবা আমি লুকিয়ে….। দাঁড়াতে গিয়ে পুতুল টাল সামলে পড়ে যেতে নেয়। সোফা থেকে মইনও দাঁড়ায়—আজ খেলবে? আচ্ছা তুমি লুকোও, আমি খুঁজে ব্বে করি।