মা মেয়েকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝাল। কাল অমন করে ওকে অভ্যর্থনা করার দরুনই যে সে এসব করেছে তাও বললে। চানভানুর মন কিন্তু কিছুতেই আর প্রসন্ন হয়ে উঠল না। আল্লারাখা কাঁটার মতো তার মনে এসে বিঁধতে লাগল।
আল্লারাখা হানিফের মতোই তিরন্দাজ। তার প্রথম তির ঠিক জায়গায় গিয়ে বিঁধেছে।
সেদিন দুপুরে যখন চানভানু আরিয়লখাঁতে স্নান করতে যাচ্ছিল, তখন তার ম্লান মুখ দেখে আল্লারাখা যেমন বিজয়ের আনন্দে নেচে উঠল, তেমনই তার বুকে কাঁটার মতো কী একটা ব্যথা যেন খচ করে উঠল। আহা! ওর মুখ মলিন! নাঃ, চানভানুও সোনাভানের মতোই তির ছুঁড়তে জানে! তারও অলক্ষ্য লক্ষ্য ঠিক জায়গায় এসে বিঁধল!
আল্লারাখার চোখে চোখ পড়তেই ম্লানমুখী চানভানুর হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। এ-হাসির জন্য সে একেবারে প্রস্তুত ছিল না। এত বড়ো শয়তানের এমন চুনিবিল্লির মতো মুখ। এতে যে মরা মানুষেরও হাসি পায়।
কিন্তু হেসেই সে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। এ-হাসির যদি আল্লারাখা অন্য মানে করে বসে। ছি ছি ছি ছি!
কিন্তু চানভানুকে এ-লজ্জার দায় বেশিক্ষণ পোহাতে হল না। ওর হাসির ছুরি একটু চিকচিকিয়ে উঠতেই আল্লারাখা রণে পৃষ্ঠভঙ্গ দিল। সে মনে করলে, এ-হাসির বিজলির পরেই বুঝি ভীষণ বজ্রপাত হবে! চান দেখতে পেল, অদূরে বিরাট বহুকালের পুরানো অশ্বত্থ গাছে আল্লারাখা তর তর করে উঠে একেবারে আগডালে গিয়ে বসল। কী ভীষণ ছেলে বাবা! ও গাছে যে সাপ আছে সবাই বলে! যদি সাপে কামড়ে দেয়, যদি ডাল ভেঙে পড়ে যায়! চানভানু খানিক দাঁড়িয়ে ওর কীর্তিকলাপ দেখে এই ভাবতে ভাবতে নদীর জলে স্নান করতে নামল।
নদীতে নেমেই তার মনে হল, ছি ছি, সে করেছে কী! কেন সে ওই বাঁদরটাকে অতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে! ও যে আস্কারা পেয়ে মাথায় চড়ে বসবে! না জানি সে এতক্ষণ কী মনে করছে!
তার আর সেদিন সাঁতার কাটা হল না। আরিয়লখাঁর জল আজ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! চানভানু চুপ করে গলাজলে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আজ তার এই প্রশ্নই মনে বারে বারে উদয় হয়েছে – কেন আল্লারাখা ওদের বাড়ি কাল এমন করে গিয়েছিল! ও তো কারুর বাড়ির ভিতর সহজে যায় না। কেন সে ওকে দেখে অমন করে তাকিয়ে ছিল। তারপর সারা গাঁয়ের লোকের উপর অত্যাচার করে কেনই বা তার অপমানের প্রতিশোধ নিলে, ওকেই বা কিছু বললে না কেন! ও শুধু বাঁদর নয়, ও বুঝি পাগলও!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল, সে বুঝি অশ্বত্থ গাছ থেকে তাকে দেখছে। অনেকটা দূরে অশ্বত্থ গাছটা। তবু সে স্পষ্ট দেখতে পেল, অশ্বত্থ গাছটার ওধারের ডাল থেকে কখন সে এধারের ডালে এসে ওরই দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। কী বালাই! চানভানুর মনে হতে লাগল, ও বুঝি আর কিছুতেই জল ছেড়ে উঠতে পারবে না! ওকে তো আরও কতবার দেখেছে, ওরই সামনে সাঁতরেওছে এই নদীতে ; কিন্তু এ লজ্জা – এ সংকোচ তো ছিল না ওর। কী কুক্ষণে কাল-সন্ধ্যায় সে ওদের বাড়িতে পা দিয়েছিল!
ও যেন কালবোশেখির মেঘের মতো, যত ভয় করে, তত দেখতেও ইচ্ছে করে!
এবারেও তাকে আল্লারাখা মুক্তি দিল। চানভানু দেখলে, আল্লারাখা গাছ থেকে নেমে যাচ্ছে।
এইবার তার ভীষণ রাগ হল ওই হতচ্ছাড়ার উপর। সে মনে করে কী। সে কি মনে করে, সে গাছে বসে থাকলে ও স্নান করে উঠে যেতে পারে না? তাই সে দয়া করে নেমে গেল! ও কি মনে করেছিল,পথে দাঁড়িয়ে থাকলে চানভানু আর নদীতে যেতেই পারবে না, ভয়ে লজ্জায়? তাই সে পথ ছেড়ে চলে গেছিল? চান নিষ্ফল আক্রোশে ফুলতে লাগল। আজ সে দেখিয়ে দেবে যে, যত বড়ো শয়তান হোক সে, তাকে চানভানু থোড়াই কেয়ার করে! জলের মধ্যে তার শরীর যেন জ্বলতে লাগল। তাড়াতাড়ি স্নান করে উঠে সে জোরে জোরে পথ চলতে লাগল। এবার যদি পথে দেখা পায় তার, তাহলে দেখিয়ে দেবে কেমন করে ওর নাকের তলা দিয়ে চান হনহনিয়ে চলে যেতে পারে। ওকে সে মানুষের মধ্যেই গণ্য করে না!
কিন্তু কোথাও কেশরঞ্জনবাবুর কেশাগ্রও সে দেখতে পেল না। এবারেও সেই অপমান, সেই দয়া? ওকে চান ঘৃণা করে – সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে! কিন্তু একী, ওকে একটু অপমান করতে পারল না বলেই কি মনটা এমন হঠাৎ মলিন হয়ে উঠল? ওকে পথে দেখতে পেল না বলে মনটা ক্রমে অপ্রসন্ন হয়ে উঠল কেন? যে জোরে সে নদী থেকে আসছিল, পায়ের সে জোর গেল কোথায়? এ কী হল আজ চানের? ওর ঘাড়ে কি তবে ভূত চাপল?
পঞ্চশরের ঠাকুরটির শরে কেউটে সাপের মতোই হয়তো তীব্র বিষ মাখানো থাকে। শর বিঁধবা মাত্র এ বিষ সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীর ছেয়ে মাথায় গিয়ে ওঠে! নইলে এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে চানের অবস্থা এমন সঙিন হয়ে উঠত না। ওকে ভুলতেও পারে না, মনে করতেও শরীর রাগের জ্বালায় তপ্ত হয়ে ওঠে।
আজ প্রথম চানভানুর আহারে অরুচি হল। মা প্রমাদ গুনলে। আইবুড়ো মেয়ে বেশি বড়ো হলে কেন যে ভূতগ্রস্ত হয় – মা যেন আজ তা বুঝতে পারল। গোপনে চোখ মুছে মনে মনে বললে, ভূতে নজর দিয়েছে মা! – আর তোকে রাখা যাবে না, এইবার তোর মায়া কাটাতে হবে!
নারদ আলি আশ্চর্য হয়ে গেল, যখন তার বউ মেয়ের পাত্র-সন্ধানের জন্য বলল তাকে। কোনো কথা হল না, দুই জনারই চোখে জল গড়িয়ে পড়ল।
২
চানভানুর বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। আর মাসখানেক মাত্র বাকি। পাশের গাঁয়ের ছেরাজ হালদারের ছেলের সাথে বিয়ে।