চুন্নু ব্যাপারীর তৃতীয় পক্ষের দুই-দুইবার মেয়ে হবার পর তৃতীয় দফায় যখন পুত্র এল, তখন সাবধানী মা তার নাম রাখলে আল্লারাখা। আল্লাকে রাখতে দেওয়া হল যে ছেলে, অন্তত তার অকালমৃত্যু সম্বন্ধে – আর কেউ না হোক মা তার নিশ্চিন্ত হয়ে রইল। আল্লা হয়তো সেদিন প্রাণ ভরে হেসেছিলেন। অমন বহু ‘আল্লারাখা’কে আল্লা ‘গোরস্থান-রাখা’ করেছেন, কিন্তু এর বেলায় যেন রসিকতা করেই একে সত্যিসত্যিই জ্যান্ত রাখলেন! মনে মনে বললেন, ‘দাঁড়া, ওকে বাঁচিয়ে রাখব, কিন্তু তোদের জ্বালিয়ে মেরে ছাড়ব!’ সে পরে মরবে কিনা জানি না, কিন্তু এই বিশটে বছর যে সে বেঁচে আছে, তার প্রমাণ গাঁয়ের লোক হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। তার বেঁচে থাকাটা প্রমাণ করার বহর দেখে গাঁয়ের লোক বলাবলি করে, ও গুয়োটা আল্লারাখা না হয়ে যদি মামদোভূত হত, তা হলেও বরং ছিল ভালো। ভূতেও বুঝি এত জ্বালাতন করতে পারে না!
ওকে মুসলমানরা বলত, ‘ইবলিশের পোলা’, কায়েতরা বলত, ‘অমাবস্যার জম্মিৎ!’ বাপ বলত, ‘হালার পো’, মা আদর করে বলত – ‘আফলাতুন!’
এইবার যে মেয়েটির কল্যাণে ওর নাম কেশরঞ্জন বাবু হয়, সেই চানভানুর একটু পরিচয় দিই।
মেয়েটি ওই গাঁয়েরই নারদ আলি শেখের। নারদ আলি নামটা হিন্দু-মুসলমান মিলনের জন্য রাখা নয়। নারদ আলি অসহযোগ আন্দোলনের অনেক আগের মানুষ। অসহযোগ আন্দোলন যদ্দিনের, তা ওর হাঁটুর বয়েস! বাম পায়ের হাঁটুর বয়েস! বাম পায়ের হাঁটু আর বললাম না, ওটা অতিরঞ্জন হবে!
নারদ আলি, শেখ রামচন্দ্র, সীতা বিবি প্রভৃতি নাম এখনও গাঁয়ে দশ-বিশটে পাওয়া যায়। অবশ্য হনুমানুল্লা, বিষ্ণু হোসেন প্রভৃতি নামও আছে কিনা জানিনে।
নারদ আলি গাঁয়ের মাতব্বর না হলেও অবস্থা ওর মন্দ নয়। যা জমি-জায়গা আছে তার, তারই উৎপন্ন ফসলে দিব্যি বছর কেটে যায়। ও কারুর ধারও ধারে না, কাউকে ধার দেয়ও না।
দিব্যি শান্তশিষ্ট মানুষটি! কিন্তু ওর বউটি ঝগড়া-কাজিয়া না করলেও কাজিয়ার ভান করে যে মজা করে, তা অন্তত নারদ আলির কাছে একটু অশান্তিকর বলেই মনে হয়। লোক খ্যাপানো বউটার স্বভাব। কিন্তু সে রসিকতা বুঝতে না পেরে অপর পক্ষ যখন খেপে ওঠে, তখন সে বেশ কিছুক্ষণ কোঁদল করার ভান করে হঠাৎ মাঝ উঠানে ধামাচাপা দিয়ে বলে ওঠে, ‘আজ রইল কাজিয়া ধামাচাপা, খাইয়া লইয়া আই, তারপর তোরে, দেখাইব মজাডা! এই ধামারে যে খুলব, তার লল্লাটে আল্লা ভাসুরের সাথে নিকা লিখছে!’ বলেই এমন ভঙ্গির সাথে সে ধামাটা চাপা দেয়, এবং কথাগুলো বলে যে, অন্য লোকের সাথে – যে ঝগড়া করছিল সেও হেসে ফেলে! অবশ্য, রাগ তাতে তার কমে না।
এদেরই একটি মাত্র সন্তান চানভানু। পুথির কেসসা শুনে মায়ের আদর করে রাখা নাম!
চানভানু যেন তার মায়েরই ঈষৎ পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ! চোখে মুখে কথা কয়, ঘাটে মাঠে ছুটোছুটি করে, আরিয়ল খাঁর দল ওর ভয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে চায়!
চোদ্দো বছর বয়স হয়ে গেল, অথচ বাপে বললেও মায়ে বিয়ের নাম করতে দেয় না। বলে, চান চলে গেলে থাকব কি করে আঁধার পুরীতে। নারদ আলি বেশি কিছু বললে বউ তার তাড়া দিয়ে বলে ওঠে, ‘তোমার খ্যাচ-খ্যাচাইবার ওইব না, আমার মাইয়্যা বিয়া বসব না – জৈগুন বিবির লাহান উয়ার হানিপ যদ্দিন না আয়ে!’
মোহনপুরের জৈগুন বিবি – চানভানুর ‘হানিফ’ বীরের কিন্তু আসতে দেরি হল না এবং সে হানিফ আমাদের আল্লারাখা।
একদিন হঠাৎ আল্লারাখার ‘সোনাভানের’র পুথি পড়তে পড়তে মনে হল, চানভানুই সে সোনাভানবিবি এবং সে গাজি হানিফা। তার কারণ, চানের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে গাঁয়ে ছিল না। সে সোনাভান বিজয়ের জন্য জয়-যাত্রার চিন্তা করতে করতে পড়ে যেতে লাগল –
‘হানিফার আওয়াজ বিবি শুনিল যখন,
নাসতা করিয়া নিল থোড়া আশি মন।
লক্ষ মনের গোর্জ বিবির হাজার মনের ঢাল,
বারো ঘোড়ায় চড়ে বলে তুলব পিঠের খাল!’
বাপপুরে! এ যে হানিফার বাবা! এ আবার আশি মন নাশতা করে, বারোটা ঘোড়ায় এক সাথে চড়ে! চানভানুও ওই রকম কিছু করবে নাকি? আল্লারাখা রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। কিন্তু হেরে হেরেও তো হানিফাই শেষে কেল্লা-ফতে করেছিলেন! যা থাকে কপালে! আল্লারাখা তার বাবরি চুলের মাঝে একটা এবং দুদিকে দুটো – এই তিন তিনটে সিঁথি কেটে, চুলে, গায়ে, ময় জামায় বেশ করে কেশরঞ্জন মেখে, গালে বেশ করে পান ঠুসে সোনাভান ওরফে চানভানুকে জয় করতে বেরিয়ে পড়ল।
এইখানে বলে রাখি, আমাদের আল্লারাখা পুথি পড়ে যতদূর আধুনিক হবার – তা হয়ে উঠেছিল। সে ঠিক চাষার ছেলের মতো থাকত না, পরিষ্কার ধুতি-জামা-জুতো পরে লম্বা চুলে তেড়ি কেটে, পান সিগারেট খেতে খেতে গাঁয়ের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিত এবং কার কি অনিষ্ট করবে তারই মতলব আঁটত। কিন্তু বয়স তার যৌবনের ‘ফ্রন্টিয়ার’ ক্রস করলেও মেয়েদের ওপর কোনো অত্যাচার কোনোদিন করেনি। তার টার্গেট ছিল বেশিরভাগ বুড়ো-বুড়ির দল ; বাড়ির, মাঠের ফল-ফসল ; গাছের আগা, ঘরের মটকা এবং রাত্রে বাঁশঝাড়, তেঁতুল গাছ, তালগাছ ইত্যাদি।
অকারণে বলদ ঠ্যাঙানো বা তাদের দড়ি খুলে দিয়ে বাবাকে লোকের গাল খাওয়ানো ছাড়া বাবার চাষবাসে অন্য বিশেষ সহায়তা সে করেনি। দু-বার সে মাঠ তদারক করতে গেছিল, তাতে একবার মাঠের পাকা ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, আর একবার সমস্ত ধান কেটে অন্যের খেতে রেখে এসেছিল। এর পর তার বাবা আর তাকে সাহায্য করতে ডাকেনি।