নূরজাহান আর আলি নসিব মিয়াঁ একেবারে মাটির সাথে মিশে গেল। দেশময় টিঁ টিঁ পড়ে গেল। অধিকাংশ লোকেই একথা বিশ্বাস করল।
আলি নসিব মিয়াঁ শত চেষ্টা করেও সবুরকে উকিল দেওয়ার জন্য রাজি করাতে পারলেন না। সে কোর্টে বলল, সে নিজেই আত্মপক্ষ সমর্থন করবে – উকিল বা সাক্ষী কিছুই নিতে চায় না সে। আলি নসিব মিয়াঁর টাকার লোভে বহু উকিল সাধ্যসাধনা করেও সবুরকে টলাতে পারল না। আলি নসিব মিয়াঁ তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে তাকে জেলে দেখা করে শেষ চেষ্টা করেছিলেন। তাতেও সফলকাম হননি। নূরজাহানের অনুরোধে সে বলেছিল, অনেক ক্ষতিই তোমাদের করে গেলাম – তার উপরে তোমাদের আরও আর্থিক ক্ষতি করে আমার বোঝা ভারী করে তুলতে চাইনে। আমায় ক্ষমা কোরো নূরজাহান, আমি তোমাদেরে আমার কথা ভুলতে দিতে চাইনে বলেই এই দয়াটুকু চাই!
সে সেশনে সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক অকপটে বলে গেল। জজ সব কথা বিশ্বাস করলেন। জুরিরা বিশ্বাস করলেন না। সবুর সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হল। আপিল করল না। সকলে বললে, আপিল করলে সে মুক্তি পাবেই। তার উত্তরে সবুর হেসে বলেছিল যে, সে মুক্তি চায় না – আমিরের যে-টুকু রক্ত তার হাতে লেগেছিল– তা ধুয়ে ফেলতে সাতটা বছরেও যদি সে পারে– সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে।
জজ তার রায়ে লিখেছিলেন, আর কাউকে দণ্ড দিতে এত ব্যথা তিনি পাননি জীবনে।
যেদিন বিচার শেষ হয়ে গেল, সেদিন সপরিবারে আলি নসিব মিয়াঁ ময়মনসিংহে ছিলেন।
নূরজাহান তার বাবাকে সেই দিনই ধরে বসে, – তারা সকলে মক্কা যাবে। আলি নসিব মিয়াঁ বহুদিন থেকে হজ করতে যাবেন বলে মনে করে রেখেছিলেন, মাঝে মাঝে বলতেনও সে কথা। নানান কাজে যাওয়া আর হয়ে উঠেনি, মেয়ের কথায় তিনি যেন আশমানের চাঁদ হাতে পেলেন। অত্যন্ত খুশি হয়ে বলে উঠলেন, ‘ঠিক কইছস বেডি, চল আমরা মক্কায় গিয়াই এ সাতটা বছর কাটাইয়া দিই। এ পাপ-পুরীতে আর থাকবাম না! আর আল্লায় যদি বাঁচাইয়া রাহে, ব্যাডা তালবিল্লিরে কইয়া যাইবাম, হে যেন একডিবার আমাদের দেখা দিয়া আইয়ে।’ ‘ব্যাডা তালবিল্লি’ বলেই হো হো করে পাগলের মতো হেসে উঠেই আলি নসিব মিয়াঁ পরক্ষণে শিশুর মতো ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
নূরজাহানের মা প্রতিবাদ করলেন না। তিনি জানতেন, মেয়ের যা কলঙ্ক রটেছে, তাতে তার বিয়ে আর এ দেশে দেওয়া চলবে না। আর, এ মিথ্যা বদনামের ভাগী হয়ে এ দেশে থাকাও চলে না।
ঠিক হল একেবারে সব ঠিকঠাক করে জমি-জায়গা বিক্রি করে শুধু নগদ টাকা নিয়ে চলে যাবেন। আলি নসিব মিয়াঁ সেইদিন স্থানীয় ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সাথে দেখা করে সম্পত্তি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে এলেন। কথা হল ব্যাঙ্কই এখন টাকা দেবে, পরে তারা সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা তুলে নেবে।
তার পরদিন সকলে জেলে গিয়ে সবুরের সাথে দেখা করলেন। সবুর সব শুনল। তার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ল। জেলের জামার হাতায় তা মুছে বললে, ‘আব্বা, আম্মা, আমি সাত বছর পরে যাইবাম আপনাদের কাছে– কথা দিতাছি।’
তারপর নূরজাহানের দিকে ফিরে বললে, ‘আল্লায় যদি এই দুনিয়ার দেখবার না দেয়, যে দুনিয়াতেই তুমি যাও আমি খুঁইজ্যা লইবাম।’ অশ্রুতে কন্ঠ নিরুদ্ধ হয়ে গেল, আর সে বলতে পারলে না । নূরজাহান কাঁদতে কাঁদতে সবুরের পায়ের ধুলা নিতে গিয়ে তার দু-ফোঁটা অশ্রু সবুরের পায়ে গড়িয়ে পড়ল! বলল, ‘তাই দোওয়া করো।’
কারাগারের দুয়ার ভীষণ শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। সেই দিকে তাকিয়ে নূরজাহানের মনে হল – তার সকল সুখের স্বর্গের দ্বার বুঝিবা চিরদিনের জন্যই রুদ্ধ হয়ে গেল!
জিনের বাদশা
ফরিদপুর জেলায় ‘আরিয়ল খাঁ’ নদীর ধারে ছোট্ট গ্রাম। নাম মোহনপুর। অধিকাংশ অধিবাসীই চাষি মুসলমান। গ্রামের একটেরে ঘরকতক কায়স্থ। যেন ছোঁয়াচের ভয়েই ওরা একটেরে গিয়ে ঘর তুলেছে।
তুর্কি ফেজের উপরের কালো ঝাণ্ডিটা যেমন হিন্দুত্বের টিকির সাথে আপস করতে চায়, অথচ হিন্দুর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে না, তেমনই গ্রামের মুসলমানেরা কায়স্থপাড়ার সঙ্গে ভাব করতে গেলেও কায়স্থ-পাড়া কিন্তু ওটাকে ভূতের বন্ধুত্বের মতোই ভয় করে।
গ্রামের মুসলমানদের মধ্যে চুন্নু ব্যাপারী মাতব্বর লোক। কিন্তু মাতব্বর হলেও সে নিজে হাতেই চাষ করে। সাহায্য করে তার সাতটি ছেলে এবং তিনটি বউ। কেন যে সে আর একটি বউ এনে সুন্নত আদায় করেনি, তা সে-ই জানে। লোকে কিন্তু বলে, তার তৃতীয় পক্ষটি একেবারে ‘খর-দজ্জাল’ মেয়ে। এরই শতমুখী অস্ত্রের ভয়ে চতুর্থ পক্ষ নাকি ও-বাড়ি মুখো হতে পারেনি। এর জন্য চুন্নু ব্যাপারীর আপশোশের আর অন্ত ছিল না। সে প্রায়ই লোকের কাছে দুঃখ করে বলত, ‘আরে, এরেই কয় – খোদায় দেয় তো জোলায় দেয় না! আল্লা মিয়াঁ তো হুকুমই দিছেন চারড্যা বিবি আনবার, তা কপালে নাই, ওইব কোহান থ্যা!’ বলেই একটু ঢোক গিলে আবার বলে, ‘ওই বিজাত্যার বেডিরে আন্যাই না এমনডা ওইল!’ বলেই আবার কিন্তু সাবধান করে দেয়, ‘দেহিয়ো বাপু, বারিত গিয়া কইয়্যা দিয়ো না। হে বেডি হুনল্যা এক্কেরে দুপুর্যা মাতম লাগাইয়া দিব!’
এই তৃতীয় পক্ষেরই তৃতীয় সন্তান ‘আল্লারাখা’ আমাদের গল্পের নায়ক। গল্পের নায়কের মতোই দুঃশীল, দুঃসাহসী, দুঁদে ছেলে সে। গ্রামে কিন্তু এর নাম ‘কেশরঞ্জন বাবু’। এ নাম এর প্রথম দেয় ওই গ্রামের একটি মেয়ে। নাম তার ‘চান ভানু’ অর্থাৎ চাঁদ বানু। সে কথা পরে বলছি।