আলি নসিব মিয়াঁ তাঁর চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি দুই হাত দিয়ে তাঁর চক্ষু ঢেকে ফেললেন।
একটু পরে ডাক্তার এবং পুলিশ দু-ই এল। আমিরকে নিয়ে ডাক্তারখানায়, সবুরকে নিয়ে গেল থানায়।
সবুরকে থানায় নিয়ে যাবার আগে দারোগাবাবু আলি নসিব মিয়াঁর অনুরোধে তাকে একবার তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সে দারোগাবাবুর কাছে একটুও অতিরঞ্জিত না করে সমস্ত কথা খুলে বললে। তার কথা অবিশ্বাস করতে কারুরই প্রবৃত্তি হল না। দারোগাবাবু বললেন, ‘কেস খুব সিরিয়স নয়, ছেলেটা বেঁচে যাবে। এ কেস আপনারা আপসে মিটিয়ে ফেলুন সাহেব।’
আলি নসিব মিয়াঁ বললেন, আমার কোনো আপত্তি নাই দারোগা সাহেব, আমিরের বাপে কি কেস মিটাইব? তারে তো আপনি জানেন। যারে কয় এক্কেরে বাঙাল!’
দারোগাবাবু বললেন ‘দেখা যাক, এখন তো ওকে থানায় নিয়ে যাই। কী করি, আমাদের কর্তব্য করতেই হবে।’
ততক্ষণে আলি নসিব মিয়াঁর বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। এই খবর শুনেই নূরজাহান মূর্ছিতা হয়ে পড়েছিল। আলি নসিব মিয়াঁ সবুরকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, তখন নূরজাহান একেবারে প্রায় সবুরের পায়ের কাছে পড়ে কেঁদে উঠল, ‘কে তোমারে এমনডা করবার কইছিল? কেন এমনডা করলে?’
নূরজাহানের মা সবুরকে তার গুণের জন্য ছেলের মতোই মনে করতেন। তা ছাড়া, তাঁর পুত্র না হওয়ায় পুত্রের প্রতি সঞ্চিত সমস্ত স্নেহ গোপনে সবুরকে ঢেলে দিয়েছিলেন। তিনি সবুরের মাথাটা বুকের উপর চেপে ধরে কেঁদে আলি নসিব মিয়াঁকে বললেন, ‘আমার পোলা এ, আমি দশ হাজার ট্যাহা দিবাম, দারোগাব্যাডারে কন, হে এরে ছ্যাইরা দিয়া যাক।’
সবুর তার রক্তমাখা হাত দিয়ে নূরজাহানকে তুলে বলে উঠল, ‘আমি যাইতেছি ভাই! যাইবার আগে দেহাইয়া গেলাম – আমিও মানুষের পোলা। এ যদি না দেহাইতাম, তুমি আমায় ঘৃণা করতা। খোদায় তোমায় সুখে রাখুন!’ বলেই তার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললে ‘আম্মাগো এই তিনডা বছরে আপনি আমায় মায়ের শোক ভুলাইছিলেন।’ আর সে বলতে পারল না – কান্নায় তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।’
আলি নসিব মিয়াঁর পদধূলি নিয়ে সে নির্বিকারচিত্তে থনায় চলে গেল। দারোগাবাবু কিছুতেই জামিন দিতে রাজি হলেন না। দশ হাজার টাকার বিনিময়েও না, খুনি আসামিকে ছেড়ে দিল তাঁর চাকরি যাবে।
নূরজাহানের কানে কেবল ধ্বনিত হতে লাগল, ‘তুমি আমায় ঘৃণা করতে।’ তার ঘৃণায় সবুরের কী আসত যেত? কেন সে তাকে খুশি করবার জন্য এমন করে ‘মরিয়া হইয়া’ উঠল? সে যদি আজ এমন করে না বলত সবুরকে, তা হলে কখনই সে এমন কাজ করত না। এমন নির্যাতন তো সে তিন বছর ধরে সয়ে আসছে। তারই জন্য আজ সে থানায় গেল। দু-দিন পরে হয়তো তার জেল, দ্বীপান্তর – হয়তো বা তার চেয়ে বেশি – ফাঁসি হয়ে যাবে! ‘উঃ’ বলে আর্তনাদ করে সে মূর্ছিতা হয়ে পড়ল।
আলি নসিব মিয়াঁ যেন আজ এক নতুন জগতের সন্ধান পেলেন। আজ সবুর তার দুঃখ দিয়ে তাঁর সুখের বাকি দিনগুলোকেও মেঘাচ্ছন্ন করে দিয়ে গেল! একবার মনে হল, বুঝি বা দুধ-কলা দিয়ে তিনি সাপ পুষেছিলেন! পরক্ষণেই মনে হল সে সাপ নয়, সাপ নয়! ও নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক ! আর – যদি সাপই হয় – তা হলেও ওর মাথায় মনি আছে ! ও জাত-সাপ।
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল, তাঁর অনুকম্পায় প্রতিপালিত হলেও বংশ-মর্যাদায় সবুর তাঁদের চেয়েও অনেক উচ্চে। আজ সে দরিদ্র, পিতৃমাতৃহীন নিঃসহায় – কিন্তু একদিন এদেরই বাড়িতে আলি নসিব মিয়াঁর পূর্বপুরুষেরা নওকরি করেছেন। তা ছাড়া এই তিন বছর তিনি সবুরকে যে অন্ন বস্ত্র দিয়েছেন তার বিনিময়ে সে তাঁর কন্যাকে উর্দু ও ফার্সিতে যে কোনো মাদ্রাসার ছেলের চেয়েও পারদর্শিনী করে দিয়ে গেছে। আলি নসিব মিয়াঁ নিজে মাদ্রাসা-পাশ হলেও মেয়ের কাছে তাঁর উর্দু ফারসি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে ভয় হয়। সে তো এতটুকু ঋণ রাখিয়া যায় নাই। শ্রদ্ধায় প্রীতিতে পুত্রস্নেহে তাঁর বুক ভরে উঠল।… যেমন করে হোক, ওকে বাঁচাতেই হবে!
নিজের জন্য নয়, নিজের চেয়েও প্রিয ওই কন্যার জন্য! আজ তো আর তাঁর মেয়ের মন বুঝতে আর বাকি নেই। অন্যের ঘরে পাঠাবার ভয়ে মেয়ের বিয়ের নামে শিউরে উঠেছেন এতদিন, আজ যদি এই ছেলের হাতে মেয়েকে দেওয়া যায় – মেয়ে সুখী হবে, তাকে পাঠাতেও হবে না অন্য ঘরে। সে-ই তো ঘরের ছেলে হয়ে থাকবে। উচ্চশিক্ষা? মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষা তো সে দিয়েইছে – পাশও করবে সে হয়তো সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে। তার পর কলেজে ভর্তি করে দিলেই হবে।
এই ভবিষ্যৎ সুখের কল্পনা করে – আলি নসিব মিয়াঁ অনেকটা শান্ত হলেন এবং মেয়েকেও সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। সে রাত্রে নূরজাহানের আর মূর্ছা হল না, সে ঘুমাতেও পারল না। সমস্ত অন্ধকার ভেদ করে তার চোখে ফুটে উঠতে লাগল – সেই দুটি চোখ, দুটি তারার মতো! প্রভাতি তারা আর সন্ধ্যাতারা।
৪
আমিরকে বাঁচানো গেল না মৃত্যুর হাত থেকে – সবুরকে বাঁচানো গেল না জেলের হাত থেকে।
ময়মনসিংহের হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে পথেই তার মৃত্যু হল। আমিরের পিতা কিছুতেই মিটমাট করতে রাজি হলেন না। তিনি এই বলে নালিশ করলেন যে, তাঁর ইচ্ছা ছিল নূরজাহানের সাথে আমিরের বিয়ে দেন, আর তা জানতে পেরেই সবুর তাকে হত্যা করেছে। তার কারণ, সবুরের সাথে নূরজাহানের গুপ্ত প্রণয় আছে। প্রমাণ-স্বরূপ তিনি বহু সাক্ষী নিয়ে এলেন – যারা ওই দুর্ঘটনার দিন নূরজাহানকে সবুরের পা ধরে কাঁদতে দেখেছে! তা ছাড়া সবুর পড়াবার নাম করে নূরজাহানের সাথে মিলবার যথেষ্ট সুযোগ পেত!