আর বলতে হল না। নিমেষে যে যেখানে পারল পালিয়ে গেল। মউলবি সাহেব তক্তাপোশে উঠে পড়ে তাঁর জাব্বা জোব্বা ঝাড়তে লাগলেন। আর ওয়াজ হল না সেদিন।…
মউলবি সাহেব যখন খেতে বসেছেন, তখন অদূরে গান শোনা গেল –
‘উলু! বোলো’ কহে সাপ
উলু বোলে – ‘বাপরে রে বাপ।’
‘কাল নসিহত হোগা ফের?’
উলু বোলে – কের কের কের!
লে উঠা লোটা কন্বল
উলু! আপনা ওতন চল!
সহসা মউলবি সাহেবের গলায় মুরগির ঠ্যাং আটকে গেল।আলি নসিব মিয়াঁ নিষ্ফল আক্রোশে ফুলতে লাগলেন।
৩
সেদিন রাস্তা দিয়ে গফরগাঁও-এর জমিদারদের হাতি যাচ্ছিল। নূরজাহান বেড়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বেচারা সবুরও হাতি দেখার লোভ সংবরণ করতে না পেরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। অদূরে সদলবলে রুস্তম দাঁড়িয়ে ছিল। সে হাতিটার দিকে দেখিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘এরিও তালবিল্লি মিয়াঁ গো! হুই তোমাগ বাছুরডা আইতেছে, ধইরা লইয়াও।’ রাস্তার সকলে হেসে গড়িয়ে পড়ল। রাস্তার একটা মেয়ে বলে উঠল, ‘বিজাত্যার পোলাডা! হাতিডা বাছুর না, বাছুর তুই!’ ভাগ্যিস রুস্তম শুনতে পায়নি।
নূরজাহান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। সে যত না রাগল ছেলেগুলোর উপর, তার অধিক রেগে উঠল সবুরের উপর। সে প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে, আজ তাকে দুটো কথা শুনিয়ে দেবে। এই কী পুরুষ! মেয়েছেলেরও অধম যে!
সেদিন সন্ধ্যায় যখন পড়াতে গেল সবুর, তখন কোনো ভূমিকা না করে নূরজাহান বলে উঠল, ‘আপনি বেডা না? আপনারে লইয়া ইবলিশা পোলাপান যা তা কইব আর আপনি হুইন্যা ল্যাজ গুডাইয়া চইলা আইবেন? আল্লায় আপনারে হাত-মুখ দিছে না।’
সবুর আজ যেন ভুলেই তার ব্যথিত চোখ দুটি নূরজাহানের মুখের উপর তুলে ধরল! কিন্তু চোখ তুলে যে রূপ সে দেখলে, তাতে তার ব্যথা লজ্জা অপমান সব ভুলে গেল সে। দুই চোখে তার অসীম বিস্ময় অনন্ত জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। এই তুমি! সহসা তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল – ‘নূরজাহান!’
নূরজাহান বিস্ময়-বিমূঢ়ার মতো তার চোখের দিকে চেয়ে ছিল। এ কোন বনের ভীরু হরিণ? অমন হরিণ-চোখ যার, সে কি ভীরু না হয়ে পারে? নূরজাহান কখনও সবুরকে চোখ তুলে চাইতে দেখেনি। সে রাস্তা চলতে কথা কইত – সব সময় চোখ নিচু করে। মানুষের চোখ যে মানুষকে এত সুন্দর করে তুলতে পারে – তা আজ সে প্রথম দেখল।
সবুরের কন্ঠে তার নাম শুনে লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে উঠল। বর্ষারাতের চাঁদকে যেন ইন্দ্রধনুর শোভা ঘিরে ফেলল।
আজ চিরদিনের শান্ত সবুর চঞ্চল মুখর হয়ে উঠেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে ঝড় উঠেছে। মৌনী পাহাড় কথা কয় না, কিন্তু সে যেদিন কথা কয়, সেদিন সে হয়ে উঠে অগ্নিগিরি।
সবুরের চোখে মুখে পৌরুষের প্রখর দীপ্তি ফুটে উঠল। সে নূরজাহানের দিকে দীপ্ত চোখে চেয়ে বলে উঠল, ‘ওই পোলাপানেরে যদি জওয়াব দিই, তুমি খুশি হও?’ নূরজাহানও চকচকে চোখ তুলে বলে উঠল, ‘কে জওয়াব দিব? আপনি?’
এ মৃদু বিদ্রুপের উত্তর না দিয়ে সবুর তার দীর্ঘায়ত চোখ দুটির জ্বলন্ত ছাপ নূরজাহানের বুকে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। নূরজাহান আত্মবিস্মৃতের মতো সেইখানে বসে রইল। তার দুটি সুন্দর চোখ আর ততোধিক সুন্দর চাউনি ছাড়া আর কোনো কিছু মনে রইল না! যে সবুরকে কেউ কখনও চোখ তুলে চাইতে দেখেনি, আজ সে উজ্জ্বলচোখে, দৃপ্তপদে রাস্তায় পায়চারি করছে দেখে সকলে অবাক হয়ে উঠল।
রুস্তমিদল গাঙের পার থেকে বেড়িয়ে সেই পথে ফিরছিল।হঠাৎ ফজল চিৎকার করে উঠল – ‘উইরে তালবিল্লি।’
সবুর ভলো করে আস্তিন গুটিয়ে নিল।
বারি পিছু দিক থেকে সবুরের মাথায় ঠোকর দিয়ে বলে উঠল, ‘প্যাঁচারে, তুমি ডাহো।’
সবুর কিছু না বলে এমন জোরে বারির এক গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলে যে, সে সামলাতে না পেরে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল। সবুরের এ অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে দলের সকলে কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
সবুর কথাটি না বলে গম্ভীরভাবে বাড়ির দিকে যেতে লাগল। বারি ততক্ষণে উঠে বসেছে। উঠেই সে চিৎকার করে উঠল – ‘সে হালায় গেল কোই?’
বলতেই সকলের যেন হুঁশ ফিরে এল। মার মার করে সকলে গিয়ে সবুরকে আক্রমণ করলে। সবুরও অসম সাহসে তাদের প্রতি-আক্রমণ করলে। সবুরের গায়ে যে এত শক্তি, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সে রুস্তমি দলের এক এক জনের টুঁটি ধরে পাশের পুকুরের জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগল।
আলি নসিব মিয়াঁর এই পুকুরটা নতুন কাটানো হয়েছিল, আর তার মাটিও ছিল অত্যন্ত পিছল। কাজেই যারা পুকুরে পড়তে লাগল গড়িয়ে – তারা বহু চেষ্টাতেও পুকুরের অত্যুচ্চ পাড় বেয়ে সহজে উঠতে পারল না। পা পিছলে বারে বারে জলে পড়তে লাগল গিয়ে। এইরূপে যখন দলের পাঁচ ছয় জন, মায় রুস্তম সর্দার জলে গিয়ে পড়েছে – তখন রুস্তমিদলের আমির তার পকেট থেকে দু-ফলা ছুরিটা বের করে সবুরকে আক্রমণ করল। ভাগ্যক্রমে প্রথম ছুরির আঘাত সবুরের বুকে না লেগে হাতে গিয়ে লাগল। সবুর প্রাণপণে আমিরের হাত মুচড়ে ধরতেই সে ছুরি সমেত উলটে পড়ে গেল এবং আমিরের হাতের ছুরি আমিরেরই বুকে আমূল বিদ্ধ হয়ে গেল। আমির একবার মাত্র ‘উঃ” বলেই অচৈতন্য হয়ে গেল! বাকি যারা যুদ্ধ করছিল – তারা পাড়ায় গিয়ে খবর দিতেই পাড়ার লোক ছুটে এল। আলি নসিব মিয়াঁও এলেন।
সবুর ততক্ষণে তার রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ক্লান্ত শরীর নিয়েই আমিরকে কোলে তুলে নিয়ে তার বুকের ছুরিটা তুলে ফেলে সেই ক্ষতমুখে হাত চেপে ধরেছে। আর তার হাত বেয়ে ফিনিক দিয়ে রক্ত-ধারা ছুটে চলছে!