সবুর এত অসহায় বলেই নূরজাহানের অন্তরের সমস্ত মমতা সমস্ত করুণা ওকে সদাসর্বদা ঘিরে থাকে। সে না থাকলে, বোধ হয় সবুরের খাওয়াই হত না সময়ে। কিন্তু নূরজাহানের এত যে যত্ন, এত যে মমতা এর বিনিময়ে সবুর এতটুকু কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়েও তাকে দেখেনি, কিছু বলা তো দূরের কথা। মারলে – কাটলেও অভিযোগ করে না, সোনা-দানা দিলেও কথা কয় না!
২
সেদিন আলি নসিব মিয়াঁর বাড়িতে একজন জবরদস্ত পশ্চিমি মউলবি সাহেব এসেছেন। রাত্রে মউলুদ শরিফ ও ওয়াজ নসিহৎ হবে। মউলবি সাহেবের সেবা-যত্নের ভার পড়েছে সবুরের উপর। বেচারা জীবনে এত বেশি বিব্রত হয়নি। কী করে, সে তার সাধ্যমতো মউলবি সাহেবের খেদমত করতে লাগল।
সবুরকে বাইরে বেরুতে দেখে রুস্তমি দলের একটি দুটি করে ছেলে এসে জুটতে লাগল। তাদের দেখে সবুর বেচারার, ভাসুরকে দেখে ভাদ্র-বউর যেমন অবস্থা হয়, তেমনই অবস্থা হল।
মউলবি সাহেবের পাগড়ির ওজন কত, দাড়ির ওজন কত, শরীরটাই বা কয়টা বাঘে খেয়ে ফুরোতে পারবে না, তাঁর গোঁফ উই-এ না ইঁদুরে খেয়েছে – এইসব গবেষণা নিয়েই রুস্তমিদল মত্ত ছিল ; রুস্তম তখন এসে পৌঁছেনি বলে সবুরকে জ্বালাতন করা শুরু করেনি।
হঠাৎ মউলবি সাহেব বিশুদ্ধ উর্দুতে সবুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কী করে। সবুর বিনীতভাবে বললে সে তালেবে এলম বা ছাত্র। আর যায় কোথায় ! ইউসুফ বলে উঠল ‘প্যাঁচা মিয়াঁ কী কইল, রে ফজল্যা?’ ফজল হেসে গড়িয়ে পড়ে বললে, ‘প্যাঁচা মিয়াঁ কইল, মুই তালবিলিম!’ ততক্ষণে রুস্তম এসে পড়েছে! সে ফজলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘কেডা তালবিল্লি! প্যাঁচা মিয়াঁ?’ ছেলেরা হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ে রোলারের মতো গড়াতে লাগল! ‘হয়! রুস্তম্যা জোর কইছে রে! তালবিল্লি! – উরে বাপপুরে! ইল্লারে বিল্লা! তালবিল্লি – হি হি হি হা হা হা’ বলে আর হেসে লুটিয়ে পড়ে। কস্তা-পেড়ে হাসি!
বেচারা সবুর ততক্ষণে মউলবি সাহেবের সেবা-টেবা ফেলে তার কামরায় ঢুকে খিল এঁটে দিয়েছে। রুস্তম সঙ্গে সঙ্গে গান বেঁধে গাইতে লাগল –
প্যাঁচা অইল তালবিল্লি,
দেওবন্দ যাইয়া যাইব দিল্লি।
আইয়া করব চিল্লাচিল্লি –
কুত্তার ছাও আর ইল্লিবিল্লি!
মউলবি সাহেব আর থাকতে পারলেন না। আস্তিন গুটিয়ে ছেলেদের তাড়া করে এলেন। ছেলেরা তাঁর বিশিষ্টরূপে শালের মতো বিশাল দেহ দেখে পালিয়ে গেল। কিন্তু যেতে যেতে গেয়ে গেল –
উলু আয়া লাহোর সে
আজ পড়েগা আলেফ বে!
মউলবি সাহেব বিশুদ্ধ উর্দু ছেড়ে দিয়ে ঠেট হিন্দিতে ছেলেদের আদ্যশ্রাদ্ধ করতে লাগলেন।
আলি নসিব মিয়াঁ সব শুনে ছেলেদের ডেকে পাঠালেন। আজ মউলবি সাহেবের সামনে তাদের বেশ করে উত্তম-মধ্যম দেবেন। কিন্তু ছেলেদের একজনকেও খুঁজে পাওয়া গেল না।
ছেলেরা ততক্ষণ তিন চার মাইল দূরে এক বিলের ধারে ব্যাং সংগ্রহের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মউলবি সাহেব তাদের তাড়া করায়, তারা বেজায় চটে গিয়ে ঠিক করেছে – আজ মউলবি সাহেবের ওয়াজ পণ্ড করতে হবে। স্থির হয়েছে ; যখন বেশ জমে আসবে ওয়াজ, তখন একজন ছেলে একটা ব্যাং-এর পেট এমন করে টিপবে যে ব্যাংটা ঠিক সাপে ধরা ব্যাং-এর মতো করে চ্যাঁচাবে; ততক্ষণ আর একজন একটা ব্যাং মজলিশের মাঝখানে ছেড়ে দেবে, সেটা যখন লাফাতে থাকবে – তখন অন্য একজন ছেলে চিৎকার করে উঠবে – সাপ! সাপ!
ব্যাস! তাইলেই ওয়াজের দফা ওইখানেই ইতি!
বহু চেষ্টার পর গোটাকতক ব্যাং ধরে নিয়ে যে-যার বাড়ি ফিরল।
আলি নসিব মিয়াঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে বারি বলে উঠল, ‘রুস্তম্যা রে, হালার তালবিল্লি পায়খানায় গিয়াছে। বদনাটা উডাইয়া লইয়া আইমু?’
রুস্তম খুশি হয়ে তখনই হুকুম দিল। বারি আস্তে আস্তে বদনাটি উঠিয়ে এনে পুকুরঘাটে রেখে দিয়ে এল।
একঘণ্টা গেল, দু-ঘণ্টা গেল, সবুর যেমন অবস্থায় গিয়ে বসেছিল তেমনই অবস্থায় বসে রইল পায়খানায়! বেরও হয় না, কাউকে দিয়ে বদনাও চায় না! দূরে আলি নসিব মিয়াঁকে দেখে ছেলের দল যেদিকে পারল পালিয়ে গেল!
আলি নসিব মিয়াঁ ভাবলেন, নিশ্চয় সবুরের কিছু একটা করেছে পাজি ছেলের দল। কিন্তু এসে সবুরকে দেখতে না পেয়ে বাড়িতে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তারাও কিছু জানে না বললে। ছেলের দল হল্লা করছিল ‘তালবিল্লি’ বলে – এইটুকু তারা জানে।
আর দুই ঘণ্টা অনুসন্ধানের পর সবুরের সন্ধান পাওয়া গেল। সবুর সব বললে। কিন্তু তাতে উলটো ফল হল। আলি নসিব মিয়াঁ তাকেই বকতে লাগলেন – সে কেন বেরিয়ে এসে কারুর কাছে বদনা চাইলে না – এ ব্যাপার শুনে নূরজাহান রাগ করার চেয়ে হাসলেই বেশি! এমনও সোজা মানুষ হয়!
আর একদিন সে হেসেছিল সবুরের দুর্দশায়। সবুর একদিন চুল কাটাচ্ছিল। রুস্তম তা দেখতে পেয়ে পিছন থেকে নাপিতকে ইশারায় একটা টাকার লোভ দেখিয়ে মাঝখানে টিকি রেখে দিতে বলে। সুশীল নাপিতও তা পালন করে। চুল কেটে স্নান করে সবুর যখন বাড়িতে খেতে গেছে, তখন নূরজাহানের চোখে পড়ে প্রথম সে দৃশ্য। নূরজাহানের হাসিতে যে ব্যথা পেয়েছিল সবুর, তা সেদিন নূরজাহানের চোখ এড়ায়নি।
আজ আবার হেসে ফেলেই নূরজাহানের মন ব্যথিত হয়ে উঠল সবুরের সেই দিনের মুখ স্মরণ করে। কী জানি কেন, তার চোখ জলে ভরে উঠল।…
সন্ধ্যায় যখন মউলবি সাহেব ওয়াজ করছেন, এবং ভক্ত শ্রোতাবৃন্দ তাঁর কথা যত বুঝতে না পারছে, তত ভক্তিতে গদ্গদ হয়ে উঠছে – তখন সহসা মজলিশের এক কোনায় অসহায় ভেকের করুণ ক্রন্দন ধ্বনিত হয়ে উঠল! শ্রোতাবৃন্দ চকিত হয়ে উঠল। একটু পরেই দেখা গেল, রক্তাক্ত কলেবর বুঝিবা সেই ভেক-প্রবরই উপবিষ্ট ভক্তবৃন্দের মাথার উপর দিয়ে হাউণ্ড রেস আরম্ভ করে দিল! সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার উঠল – “সাপ! সাপ!’