এ যেন পরির দেশের স্বপ্নমায়া, চোখ চাইলেই স্বপ্ন টুটে যাবে!
এ যেন মায়া-মৃগ – ধরতে গেলেই হাওয়ায় মিশিয়ে যাবে!
গান শেখালাম – বিদায়ের গান নয়। বিদায়ের ছাড়া আর সব কিছুর গান। বিদায় বেলা তো আসবেই – তবে আর কথা বলে ওর সব বেদনা সব মাধুর্যটুকু নষ্ট করি কেন?
সেদিনকার সন্ধ্যা ছিল নিষ্কলঙ্ক – নির্মেঘ – নিরাভরণ। আমি প্রফেসর চৌধুরিকে বললাম – আজকের সন্ধ্যাটা আশ্চর্য ভালোমানুষ সেজেছে তো! কোনো বেশভূষা নাই।
বলতেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রফেসর চৌধুরি বলে উঠলেন – ‘সন্ধ্যা আজ বিধবা হয়েছে!’
এই একটি কথায় ওঁর মনের কথা বুঝতে পারলাম। এই শান্ত সৌম্য মানুষটির বুকেও কী ঝড় উঠেছে বুঝলাম। মনে মনে বললাম – তুমি অটল পাহাড়, তোমার পায়ের তলায় বসে শুধু ধ্যান করতে হয়! তোমাকে তো ঝড় স্পর্শ করতে পারে না!
বৃদ্ধ বুঝি মন দিয়ে আমার মনের কথা শুনেছিলেন। ম্লান হাসি হেসে বললেন – ‘আমি অতি ক্ষুদ্র, বাবা! পাহাড় নয়, বল্মীকস্তূপ! তবু তোমাদের শ্রদ্ধা দেখে গিরিরাজ হতেই ইচ্ছা করে!
আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই শিউলি আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল – ‘এই যে সন্ধ্যা দেবী!’ বলেই লজ্জিত হয়ে পড়লাম।
শিউলির সোনার তনু ঘিরে ছিল সেদিন টকটকে লাল রং-এর শাড়ি। ওকে লাল শাড়ি পরতে আর কোনোদিন দেখিনি। মনে হল, সারা আকাশকে বঞ্চিত করে সন্ধ্যা আজ মূর্তি ধরে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। তার দেহে রক্ত-ধারা রং-এর শাড়ি, তার মনে রক্ত-ধারা, মুখে অনাগত নিশীথের ম্লান ছায়া! চোখ যেমন পুড়িয়ে গেল, তেমনই পুরবির বাঁশি বেজে উঠল।
শিউলির কাছে দু-একটা বাংলা গান শিখেছিলাম। আমি বললাম – ‘একটা গান গাইব?’ শিউলি আমার পায়ের কাছে ঘাসের উপর বসে পড়ে বলল – ‘গান!’
আমি গাইলাম-
‘বিবাহের রঙে রাঙা হয়ে এল
সোনার গগন রে?’
প্রফেসর চৌধুরি উঠে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, ‘বাবাজি, আজ একবার শেষ বার দাবা খেলতে হবে!’
চৌধুরি সাহেব উঠে যেতে আমি বললাম – ‘আচ্ছা ভাই শিউলি আবার যখন এমনই আশ্বিন মাস – এমনই সন্ধ্যা আসবে – তখন কী করব, বলতে পারো?’
শিউলি তার দু-চোখ ভরা কথা নিয়ে আমার চোখের উপর যেন উজার করে দিল। তার পর ধীরে ধীরে বলল, – ‘শিউলিফুলের মালা নিয়ে জলে ভাসিয়ে দিয়ো!’
আমি নীরবে সায় দিলাম – তাই হবে! জিজ্ঞাসা করলাম – ‘তুমি কী করবে!’ সে হেসে বললে, ‘আশ্বিনের শেষে তো শিউলি ঝরেই পড়ে!’
আমাদের চোখের জল লেগে সন্ধ্যাতারা চিকচিক করে উঠল।
রাত্রে দাবা-খেলার আড্ডা বসল! প্রফেসর চৌধুরি আমার কাছে হেরে গেলেন। আমি শিউলির কাছে হেরে গেলাম! জীবনে আমার সেই প্রথম এবং শেষ হার! আর সেই হারই আমার গলার হার হয়ে রইল!
সকালে যখন বিদায় নিলাম – তখন তাদের বাংলোর চারপাশে উইলো-তরু তুষারে ঢাকা পড়েছে!
আর তার সাথে দেখা হয়নি– হবেও না! একটু হাত বাড়ালে হয়তো তাকে ছুঁতে পারি, এত কাছে থাকে সে । তবু ছুঁতে সাহস হয় না। শিউলিফুল – বড়ো মৃদু, বড়ো ভীরু, গলায় পরলে দু-দণ্ডে আঁউরে যায়! তাই শিউলিফুলের আশ্বিন যখন আসে – তখন নীরবে মালা গাঁথি আর জলে ভাসিয়ে দিই!