আমি একটা বেশি বল কেটে নিতেই বৃদ্ধ আমার পিঠ চাপড়ে তারিফ করে ডিফেন্সিভ খেলা খেলতে লাগলেন। তিনি আমার গজের খেলার যথেষ্ট প্রশংসা করলেন। শিউলি বিস্ময় ও প্রশংসার দৃষ্টি দিয়ে বারেবারে আমার দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু একটা বল কম নিয়েও বৃদ্ধ এমন ভালো খেলতে লাগলেন যে, আমি পাছে হেরে যাই এই ভয়ে খেলাটা ড্র করে দিলাম। বৃদ্ধ বারংবার আমার প্রশংসা করতে করতে বললেন, ‘দেখলি মা শিউলি, আমাদের খেলোয়াড়দের বিশ্বাস, গজ ঘোড়ার মতো খেলে না। দেখলি জোড়া গজে কী খেললে! বড়ো ভালো খেল বাবা তুমি! আমি হারি কিংবা হারাই, ড্র সহজে হয় না!’
শিউলি হেসে বললে, কিন্তু তুমি হারনি কত বছর বলো তো বাবা!’
প্রফেসর চৌধুরি হেসে বললেন, না মা, হেরেছি। সে আজ প্রায় পনেরো বছর হল, একজন পাড়াগাঁয়ে ভদ্রলোক – আধুনিক শিক্ষিত নন – আমায় হারিয়ে দিয়ে গেছিলেন। ওঃ, ওরকম খেলোয়াড় আর দেখিনি!’
আবার খেলা আরম্ভ হতেই বিনয় হেসে বলে উঠল, ‘এইবার মিস চৌধুরি খেলুন না মিস্টার আজহারের সাথে!’
বৃদ্ধ খুশি হয়ে বললেন, ‘বেশ তো! তুই-ই খেল মা, আমি একবার দেখি!’
শিউলি লজ্জিত হয়ে বলে উঠল, ‘আমি কি ওঁর সঙ্গে খেলতে পারি?’
কিন্তু সকলের অনুরোধে সে খেলতে বসল। মাঝে চেসবোর্ড একধারে চেয়ারে শিউলি – একধারে আমি! তার কেশের গন্ধ আমার মস্তিষ্ককে মদির করে তুলছিল। আমার দেখে মনে যেন নেশা ধরে আসছিল। আমি দু-একটা ভুল চাল দিতেই শিউলি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নত করে ফেললে। মনে হল, তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। সে হাসি যেন অর্থপূর্ণ।
আবার ভুল করতেই আমি চাপায় পড়ে আমার একটা নৌকা হারালাম। বৃদ্ধ যেন একটু বিস্মিত হলেন। বিনয়বাবুর দল হেসে বলে উঠলেন – ‘এইবার মিস্টার আজহার মাত হবেন।’ মনে হল, এ হাসিতে বিদ্রুপ লুকোনো আছে।
আমি এইবার সংযত হয়ে মন দিয়ে খেলতে লাগলাম। দুই গজ ও মন্ত্রী দিয়ে এবং নিজের কোটের বোড়ে এগিয়ে এমন অফেন্সিভ খেলা খেলতে শুরু করে দিলাম যে, প্রফেসার চৌধুরিও আর এ-খেলা বাঁচাতে পারলেন না। শিউলি হেরে গেল! সে হেরে গেলেও এত ভালো খেলেছিল যে, আমি তার প্রশংসা না করে থাকতে পারলাম না। আমি বললাম – ‘দেখুন, মেয়েদের ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ান মিস মেনচিকের সাথেও খেলেছি, কিন্তু এত বেশি বেগ পেতে হয়নি আমাকে, আমি তো প্রায় হেরেই গেছিলাম।’
দেখলাম আনন্দে লজ্জায় শিউলি কমলফুলের মতো রাঙা হয়ে উঠেছে! আমি বেঁচে গেলাম। সে যে হেরে গিয়ে আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়নি – এই আমার যথেষ্ট সৌভাগ্য মনে করলাম।
প্রফেসার চৌধুরির সঙ্গে আবার খেলা হল, এবারও ড্র হয়ে গেল।
বৃদ্ধের আনন্দ দেখে কে! বললেন, ‘হাঁ, এতদিন পরে একজন খেলোয়াড় পেলুম, যার সঙ্গে খেলতে হলে অন্তত আট চাল ভেবে খেলতে হয়!’
কথা হল, এরপর রোজ প্রফেসার চৌধুরির বাসায় দাবার আড্ডা বসবে।
উঠবার সময় হঠাৎ বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ‘মা শিউলি, এতক্ষণ খেলে মিস্টার আজহারের নিশ্চয়ই বড্ড কষ্ট হয়েছে, ওঁকে একটু গান শোনাও না!’ আমি তৎক্ষণাৎ বসে পড়ে বললাম, ‘বাঃ এ খবর তো জানতাম না।’
শিউলি কুন্ঠিতস্বরে বলে উঠল, ‘এই শিখছি কিছুদিন থেকে, এখনও ভালো গাইতে জানিনে!’
শিউলির আপত্তি আমাদের প্রতিবাদে টিকল না। সে গান করতে লাগল।
সে গান যারই লেখা হোক – আমার মনে হতে লাগল – এর ভাষা যেন শিউলিরই প্রাণের ভাষা – তার বেদনা নিবেদন।
এক একজনের কন্ঠ আছে – যা শুনে এ কন্ঠ ভালো কি মন্দ বুঝবার ক্ষমতা লোপ করে দেয়! সে কন্ঠ এমন দরদে ভরা – এমন অকৃত্রিম যে, তা শ্রোতাকে প্রশংসা করতে ভুলিয়ে দেয়। ভালোমন্দ বিচারের বহু ঊর্ধ্বে সে কন্ঠ, কোনো কর্তব নেই, সুর নিয়ে কোনো কৃচ্ছ্রসাধনা নেই, অথচ হৃদয়কে স্পর্শ করে। এর প্রশংসাবাণী উথলে উঠে মুখে নয় – চোখে!
এ সেই কন্ঠ! মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বলবার ইচ্ছা ছিল না। ভদ্রতার খাতিরে একবার মাত্র বলতে গেলাম, ‘অপূর্ব!’ গলার স্বর বেরুল না। শিউলির চোখে পড়ল – আমার চোখের জল। সে তার দীর্ঘায়ত চোখের পরিপূর্ণ বিস্ময় নিয়ে যেন সেই জলের অর্থ খুঁজতে লাগল।
হায়, সে যদি জানত – কালির লেখা মুছে যায়, জলের লেখা মোছে না!
সেদিন আমায় নিয়ে কে কী ভেবেছিল – তা নিয়ে সেদিনও ভাবিনি, আজও ভাবি না। ভাবি – শিউলিফুল যদি গান গাইতে পারত, সে বুঝি এমনি করেই গান গাইত। গলায় তার দরদ, সুরে তার এমনি আবেগ!
সুরের যেটুকু কাজ সে দেখাল, তা ঠুংরি ও টপ্পা মেশানো। কিন্তু বুঝলাম, এ তার ঠিক শেখা নয় – গলার ও-কাজটুকু স্বতঃস্ফূর্ত! কমল যেমন না জেনেই তার গন্ধ-পরাগ ঘিরে শতদলের সুচারু সমাবেশ করে – এও যেন তেমনই।
গানের শেষে বলে উঠলাম, ‘আপনি যদি ঠুংরি শেখেন, আপনি দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুর-শিল্পী হতে পারেন! কী অপূর্ব সুরেলা কন্ঠস্বর।’
শিউলিফুলের শাখায় চাঁদের আলো পড়লে তা যেমন শোভা ধারণ করে, আনন্দ ও লজ্জা মিশে শিউলিকে তেমনই সুন্দর দেখাচ্ছিল।
শিউলি তার লজ্জাকে অতিক্রম করে বলে উঠল, ‘না, না, আমার গলা একটু ভাঙা। সে যাক, আমার মনে হচ্ছে আপনি গান জানেন। জানেন যদি, গান না একটা গান।’
আমি একটু মুশকিলে পড়লাম! ভাবলাম, ‘না বলি। আবার গান শুনে গলাটাও গাইবার জন্য সুড়সুড় করছে! বললাম, ‘আমি ঠিক গাইয়ে নই, সমঝদার মাত্র! আর যা গান জানি, তাও হিন্দি।’