দাবাড়ে দলের আপত্তি টিকল না। আজহারকে গাইতে হল। আজহার চমৎকার ঠুংরি গায়। বিশুদ্ধ লখনউ ঢং-এর ঠুংরি গান তার জানা ছিল। এবং তা এমন দরদ দিয়ে গাইত সে, যে শুনত সেই মুগ্ধ হয়ে যেত। আজ কিন্তু সে কেবলই গজল গাইতে লাগল।
আজহার অন্য সময় সহজে গজল গাইতে চাইত না।
মুখার্জি হেসে বলে উঠল,– ‘আজ তোমার প্রাণে বিরহ উথলে উঠল নাকি হে? কেবলই গজল গাচ্ছ, মানে কী? রংটং ধরেছে নাকি কোথাও!’
আজহারও হেসে বলল, ‘বাইরের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো।’
এতক্ষণে যেন সকলের বাইরের দিকে নজর পড়ল। একটু আগের বর্ষা-ধোয়া ছলছলে আকাশ। যেন একটি বিরাট নীল পদ্ম। তারই মাঝে শরতের চাঁদ যেন পদ্মমণি। চারপাশে তারা যেন আলোক-ভ্রমর।
লেক-রোডের পাশে ছবির মতো বাড়িটি।
শিউলির সাথে রজনিগন্ধার গন্ধ-মেশা হাওয়া মাঝে মাঝে হলঘরটাকে উদাস-মদির করে তুলছিল!
২
সকলের আর এক প্রস্থ চা খাওয়া হলে পর সিগার ধরিয়ে মিনিটখানিক ধূম্র উদ্গীরণ করে আজহার বলতে লাগল–
তখন সবেমাত্র ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেই শিলং বেড়াতে গেছি। ভাদ্র মাস। তখনও পূজার ছুটিওয়ালার দল এসে ভিড় জমায়নি। তবে আগে থেকেই দু-একজন করে আসতে শুরু করেছেন। ছেলেবেলা থেকেই আমার দাবাখেলার ওপর বড্ডো বেশি ঝোঁক ছিল। ও ঝোঁক বিলেতে গিয়ে আরও বেশি করে চাপল। সেখানে ইয়েটস্, মিচেল, উইন্টার, টমাস প্রভৃতি সকল নাম-করা খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলেছি এবং কেম্ব্রিজের হয়ে অনেকগুলো খেলা জিতেওছি। শিলং গিয়ে খুঁজতেই দু-একজন দাবা-খেলোয়াড়ের সঙ্গে পরিচয়ও হয়ে গেল। তবে তারা কেউ বড়ো খেলোয়াড় নয়। তারা আমার কাছে ক্রমাগত হারত। একদিন ওরই মধ্যে একজন বলে উঠল, ‘একজন বুড়ো রিটায়ার্ড প্রফেসর আছেন এখানে, তিনি মস্ত বড়ো দাবাড়ে, শোনা যায় – তাঁকে কেউ হারাতে পারে না – যাবেন খেলতে তাঁর সাথে?’
আমি তখনই উঠে পড়ে বললাম, ‘এখনই যাব, চলুন কোথায় তিনি?’
সে ভদ্রলোকটি বললেন, ‘চলুন না, নিয়ে যাচ্ছি! আপনার মতো খেলোয়াড় পেলে তিনি বড়ো খুশি হবেন। তাঁরও আপনার মতোই দাবা-খেলার নেশা। অদ্ভুত খেলোয়াড় বুড়ো, চোখ বেঁধে খেলে মশাই!’
আমি ইউরোপে অনেকেরই ‘ব্লাইন্ড ফোল্ডেড’ খেলা দেখেছি, নিজেও অনেকবার খেলেছি। কাজেই এতে বিশেষ বিস্মিত হলাম না।
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আকাশে এক ফালি চাঁদ, বোধ হয় শুক্লাপঞ্চমীর। যেন নতুন আশার ইঙ্গিত। সারা আকাশে যেন সাদা মেঘের তরণির বাইচ খেলা শুরু হয়েছে। চাঁদ আর তারা তার মাঝে যেন হাবুডুবু খেয়ে একবার ভাসছে একবার উঠছে।
ইউক্যালিপটাস আর দেবদারু তরুঘেরা একটি রঙিন বাংলোয় গিয়ে আমরা উঠতেই দেখি, প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়েস এক শান্ত সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটি তরুণীর সঙ্গে দাবা খেলছেন।
আমাদের দেশের মেয়েরাও দাবা খেলেন, এই প্রথম দেখলাম।
বিস্ময়-শ্রদ্ধা-ভরা দৃষ্টি দিয়ে তরুণীর দিকে তাকাতেই তরুণীটি উঠে পড়ে বললে, ‘বাবা, দ্যাখো কারা এসেছেন!’
খেলাটা শেষ না হতেই মেয়ে উঠে পড়েতে বৃদ্ধ ভদ্রলোক যেন একটু বিরক্ত হয়েই আমাদের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই হাসিমুখে উঠে বললেন ‘আরে, বিনয়বাবু যে! এঁরা, কারা? এসো, বোসো। এঁদের পরিচয় —’
বিনয়বাবু – যিনি আমার নিয়ে গেছিলেন, আমার পরিচয় দিতেই বৃদ্ধ লাফিয়ে উঠে আমায় একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, ‘আপনি – এই তুমিই আজহার? আরে, তোমার নাম যে চেস-ম্যাগাজিনে, কাগজে অনেক দেখেছি। তুমি যে মস্ত বড়ো খেলোয়াড়! ইয়েটসের সঙ্গে বাজি চটিয়েছ, একী কম কথা! এই তো তোমার বয়েস! – বড়ো খুশি হলুম – বড়ো খুশি হলুম।… ওমা শিউলি, একজন মস্ত দাবাড়ে এসেছে! দেখে যাও! বাঃ, বড়ো আনন্দে কাটবে তাহলে। এই বুড়োবয়সেও আমার বড্ডো দাবা-খেলার ঝোঁক, কী করি, কাউকে না পেয়ে মেয়ের সাথেই খেলছিলুম!’ বলেই হো হো করে প্রাণখোলা হাসি হেসে শান্ত সন্ধ্যাকে মুখরিত করে তুললেন।
শিউলি নমস্কার করে নীরবে তার বাবার পাশে এসে বসল। তাকে দেখে আমার মনে হল এ যেন সত্যই শরতের শিউলি।
গায়ে গোধূলি রং-এর শাড়ির মাঝে নিষ্কলঙ্ক শুভ্র মুখখানি – হলুদ রং বোঁটায় শুভ্র শিউলিফুলের মতোই সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমার চেয়ে থাকার মাত্রা হয়তো একটু বেশিই হয়ে পড়েছিল। বৃদ্ধের উক্তিতে আমার চমক ভাঙল।
বৃদ্ধ যেন খেলার জন্য অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিলেন। চাকর চায়ের সরঞ্জাম এনে দিতেই শিউলি চা তৈরি করতে করতে হেসে বলে উঠল, ‘বাবার বুঝি আর দেরি সইছে না?’ বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘কিছু মনে করবেন না! বাবা বড্ড দাবা খেলতে ভালোবাসেন! দাবা খেলতে না পেলেই ওঁর অসুখ হয়!’ বলেই চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এইবার চা খেতে খেতে খেলা আরম্ভ করুন, আমরা দেখি!’
বিনয় হেসে বলল, ‘হাঁ, এইবার সমানে সমানে লড়াই। বুঝলে মা মিস চৌধুরি, আমাদের রোজ উনি হারিয়ে ভূত করে দেন।’
খেলা আরম্ভ হল। সকলে উৎসুক হয়ে দেখতে লাগল, কেউ কেউ উপরচালও দিতে লাগল। মিস চৌধুরি ওরফে শিউলি তার বাবার যা দু একটি ত্রুটি ধরিয়ে দিলে, তাতে বুঝলাম – এও এর বাবার মতোই ভালো খেলোয়াড়।
কিছুক্ষণ খেলার পর বুঝলাম, আমি ইউরোপে যাঁদের সঙ্গে খেলেছি– তাঁদের অনেকের চেয়েই বড়ো খেলোয়াড় প্রফেসর চৌধুরি॥ আমি প্রফেসর চৌধুরিকে জানতাম বড়ো কেমিস্ট বলে, কিন্তু তিনি যে এমন অদ্ভুত ভালো দাবা খেলতে পারেন, এ আমি জানতাম না।