প্যাঁচা মিয়াঁ কেতাব পড়ে
হাঁড়ি নড়ে দাড়ি নড়ে!
নূরজাহান রাগে তার বাবার দিকে ফিরেও তাকাল না। তার যত রাগ পড়ল গিয়ে তার বাবার উপরে। তার বাবা তো ইচ্ছা করলেই ওদের ধমকে দিতে পারেন। বেচারা সবুর গরিব, স্কুলে পড়ে না, মাদ্রাসায় পড়ে – এই তো তার অপরাধ। মাদ্রাসায় না পড়ে সে যদি খানায় পড়ত ডোবায় পড়ত – তাতেই বা কার কী ক্ষতি হত। কেন ওরা আদা-জল খেয়ে ওর পিছনে এমন করে লাগবে?
আলি নসিব মিয়াঁ সব বুঝলেন। কিন্তু বুঝেও তিনি কিছুতেই হাসি চাপতে পারলেন না। হেসে ফেলে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘কি হইছেরে বেডি? ছেমরাডা প্যাঁচার লাহান বাড়িতে বইয়্যা রইব, একডা কতা কইব না, তাইনাসেন উয়ারে প্যাঁচা কয়।’ নূরজাহান রেগে উত্তর দিল, ‘আপনি আর কইবেন না, আব্বা, হে বেডায় ঘরে বইয়া কাঁদে আর আপনি হাসেন! আমি পোলা অইলে এইদুন একচটকনা দিতাম রুস্তম্যারে আর উই ইবলিশা পোলাপানেরে, যে, ওই হ্যানে পাইর্যা যাইত উৎকা মাইর্যা। উইঠ্যা আর দানাপানি খাইবার অইত না!’ বলেই কেঁদে ফেললে।
আলি নসিব মিয়াঁ মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘চুপ দে বেডি, এইবারে ইবলিশের পোলারা আইলে দাবার পইর্যা লইয়া যাইব! মুনশি বেডারে কইয়্যা দিবাম, হে ওই রুস্তম্যারে ধইরা তার কান দুডা এক্কেরে মুতা কইর্যা কাইট্যা হালাইবো!’
নূরজাহান অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠল।
সে তাড়াতাড়ি উঠে বলল, ‘আব্বাজান, চা খাইবেন নি?’
আলি নসিব মিয়াঁ হেসে ফেলে বললেন, ‘বেডির বুঝি য়্যাহন চায়ের কথা মনে পল।’
নূরজাহান আলি নসিব মিয়াঁর একমাত্র সন্তান বলে অতিমাত্রায় আদুরে মেয়ে। বয়স পনেরো পেরিয়ে গেছে। অথচ বিয়ে দেবার নাম নেই বাপ-মায়ের। কথা উঠলে বলেন, মনের মতো জামাই না পেলে বিয়ে দেওয়া যায় কী করে! মেয়েকে তো হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া যায় না! আসল কথা তা নয়। নূরজাহানের বাপ-মা ভাবতেই পারেন না, ওঁদের ঘরের আলো নূরজাহান অন্য ঘরে চলে গেলে তাঁরা এই আঁধার পুরীতে থাকবেন কী করে! নইলে এত ঐশ্বর্যের একমাত্র উত্তরাধিকারিণীর বরের অভাব হয় না। সন্বন্ধও যে আসে না, এমন নয় ; কিন্তু আলি নসিব মিয়াঁ এমন উদাসীনভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলেন যে, তারা আর বেশি দূর না এগিয়ে সরে পড়ে।
নূরজাহান বাড়িতে থেকে সামান্য লেখাপড়া শিখেছে। এখন সবুরের কাছে উর্দু পড়ে। শরিফ ঘরের এত বড়ো মেয়েকে অনাত্মীয় যুবকের কাছে পড়তে দেওয়া দূরের কথা, কাছেই আসতে দেয় না বাপ মা ; কিন্তু এদিক দিয়ে সবুরের এতই সুনাম ছিল যে, সে নূরজাহানকে পড়ায় জেনেও কোনো লোক এতটুকু কথা উত্থাপন করেনি।
সবুর যতক্ষণ নূরজাহানকে পড়ায় ততক্ষণ একভাবে ঘাড় হেঁট করে বসে থাকে, একটিবারও নূরজাহানের মুখের দিকে ফিরে তাকায় না। বাড়ি ঢোকে মাথা নিচু করে, বেরিয়ে যায় মাথা নিচু করে! নূরজাহান, তার বাবা মা সকলে প্রথম প্রথম হাসত – এখন সয়ে গেছে!
সত্যসত্যই, এই তিন বছর সবুর এই বাড়িতে আছে, এর মধ্যে সে একদিনের জন্যও নূরজাহানের হাত আর পা ছাড়া মুখ দেখেনি।
এ নূরজাহান জাহানের জ্যোতি না হলেও বীররামপুরের জ্যোতি – জোহরা সেতারা, এ সম্বন্ধে কারও মতদ্বৈধ নাই। নূরজাহানের নিজেরও যথেষ্ট গর্ব আছে, মনে মনে তার রূপের সম্বন্ধে।
আগে হত না – এখন কিন্তু নূরজাহানের সে অহংকারে আঘাত লাগে – দুঃখ হয় এই ভেবে যে, তার রূপের কি তা হলে কোনো আকর্ষণই নেই? আজ তিন বছর সে সবুরের কাছে পড়ছে – এত কাছে তবু সে একদিন মুখ তুলে তাকে দেখল না? সবুর তাকে ভালোবাসুক – এমন কথা সে ভাবতেই পারে না, – কিন্তু ভালো না বাসলেও যার রূপের খ্যাতি এ অঞ্চলে – যাকে একটু দেখতে পেলে অন্য যে কোনো যুবক জন্মের জন্য ধন্য হয়ে যায় – তাকে একটিবার একটুক্ষণের জন্যেও চেয়েও দেখল না! তার সতীত্ব কি নারীর সতীত্বের চেয়েও ঠুনকো?
ভাবতে ভাবতে সবুরের উপর তার আক্রোশ বেড়ে ওঠে, মন বিষিয়ে যায়, ভাবে আর তার কাছে পড়বে না! কিন্তু যখন দেখে – নির্দোষ নির্বিরোধ নিরীহ সবুরের উপর রুস্তমি দল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, তখন আর থাকতে পারে না। আহা, বেচারার হয়ে কথা কইবার যে কেউ নেই! সে নিজেও যে একটিবার মুখ ফুটে প্রতিবাদ করে না। এ কী পুরুষ মানুষ বাবা! মার, কাট, মুখ দিয়ে কথাটি নেই! এমন মানুষও থাকে দুনিয়াতে!
যত সে এইসব কথা ভাবতে থাকে, তত এই অসহায় মানুষটির ওপর করুণায় নূরজাহানের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে!
সবুর পুরুষ বলতে যে মর্দ-মিনসে বোঝায় – তা তো নয়ই, সুপুরুষও নয়। শ্যামবর্ণ একহারা চেহারা। রূপের মধ্যে তার চোখ দুটি। যেন দুটি ভীরু পাখি। একবার চেয়েই অমনি নত হয়। সে চোখ, তার চাউনি – যেমন ভীরু, তেমনই করুণ, তেমনই অপূর্ব। পুরুষের অত বড়ো অত সুন্দর চোখ সহজে চোখে পড়ে না।
এই তিন বছর সে এই বাড়িতে আছে, কিন্তু কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা না করলে – সে অন্য লোক তো দূরের কথা – এই বাড়িরই কারুর সাথে কথা কয়নি। নামাজ পড়ে, কোরান তেলাওত করে, মাদ্রাসা যায়, আসে, পড়ে কিংবা ঘুমোয় – এই তার কাজ। কোনোদিন যদি ভুলক্রমে ভিতর থেকে খাবার না আসে, সে না খেয়েই মাদ্রাসা চলে যায় – চেয়ে খায় না। পেট না ভরলেও দ্বিতীয়বার খাবার চেয়ে নেয় না। তেষ্টা পেলে পুকুরঘাটে গিয়ে জল খেয়ে আসে, বাড়ির লোকের কাছে চায় না।