পিতা-মাতা পুত্রকে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। শত দরিদ্রকে ডাকাইয়া দান খয়রাত করিলেন। সন্ধ্যায় বাড়িতে মউলুদ শরিফের ব্যবস্থা করিলেন।
তখনও সূর্য অস্ত যায় নাই, এমন সময় বাড়ির দ্বারে আসিয়া জোহরার পালকি থামিল।
জোহরা পালকি হইতে মৃত্যু-পাণ্ডুর মুখে নামিতেই সম্মুখে আরিফকে দেখিয়া চিৎকার করিয়া তাহার পায়ে পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘তুমি এসেছ –বেঁচে ফিরে এসেছ?’
বলিতে বলিতে সে মূর্ছিতা হইয়া পড়িল। সকলে ধরাধরি করিয়া তাহাকে ভিতরে লইয়া গেলেন। মূর্ছা ভাঙিয়া কথঞ্চিৎ সুস্থ হইলে, আরিফের পিতা-মাতা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, ‘তোরা দু-জনই কি মরতে মরতে ফিরে এলি?’
মাতা কাঁদিতে লাগিলেন, ‘আমার সোনার প্রতিমার কে এমন অবস্থা করলে!’
আরিফ জোহরাকে নিভৃতে ডাকিয়া সমস্ত কথা খুলিয়া বলিল। জোহরা স্বামীর পায়ে মাথা রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল, ‘না, না, তুমি শাস্তি দাও। তোমরা আমায় ঘৃণা করো, মারো!’
আরিফ জোহরার অধর দংশন করিয়া বলিল, ‘এই নাও শাস্তি!’
৬
দুঃখ বিপদের এই ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝেও জোহরা তাহার পদ্ম-গোখরোর কথা ভোলে নাই। এতদিন সে তেমনই নীরবে তাহাদের কথা ভুলিয়া আছে, যেমন করিয়া সে তাহার মৃত খোকাদের ভুলিয়াছে! কিন্তু সে কি ভুলিয়া থাকা! এই নীরব অন্তর্দাহের বিষ-জ্বালা তাহাকে আজ মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত ঠেলিয়া আনিয়াছে। সে সর্বদা মনে করে, সে বেদেনি, সে সাপুড়ের মেয়ে! সে ঘুমে জাগরণে শুধু সর্পের স্বপ্ন দেখে। সে কল্পনা করে, তাহার স্বামী নাগলোকের অধীশ্বর, সে নাগমাতা, নাগ-রাজেশ্বরী!
বাড়িতে আসিয়া অবধি কাহাকেও পদ্ম-গোখরোর কথা জিজ্ঞাসা না করায়, শ্বশুর-শাশুড়ি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিলেন, বউ ওদের কথা বোধ হয় ভুলিয়া গিয়াছে।
গভীর রাত্রে জোহরা স্বপ্নে দেখিতেছিল, তাহার মৃত খোকা দুইজন যেন আসিয়া বলিতেছে, ‘মা গো, বড়ো খিদে, কতদিন আমাদের দুধ দাওনি। আমরা কবরে শুয়ে আছি, আর উঠতে পারিনে! একটু দুধ! বড়ো খিদে!’ ‘খোকা’ ‘খোকা’ বলিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া জোহরা জাগিয়া উঠিল। দেখিল, স্বামী ঘুমাইতেছে। প্রদীপ জ্বালিয়া কী যেন অন্বেষণ বরিল, কেহ কোথাও নাই।
সে আজ উন্মাদিনী। সে আজ শোকাতুরা মা, সে পুত্রহারা জননী! তাহার হারা-খোকা ডাক দিয়াছে, তাহারা ছয় মাস না খাইয়া আছে।
পাগলের মতো সে দ্বার খুলিয়া বাহির হইয়া গেল। বাড়ির সম্মুখেই মির পরিবারের গোরস্থান। ক্ষীণ শিখা প্রদীপ লইয়া উন্মাদিনী মাতা দুইটি ছোট্ট কবরের পার্শ্বে আসিয়া থামিল। পাশাপাশি দুইটি ছোট্ট কবর, যেন দুটি যমজ ভাই – গলাগলি করিয়া শুইয়া আছে।
শিয়রে দুইটি কৃষ্ণচূড়ার গাছ, জোহরাই স্বহস্তে রোপণ করিয়াছিল। এইবার তাহাতে ফুল ধরিয়াছে। রক্তবর্ণের ফুলে ফুলে কবর দুইটি ছাইয়া গিয়াছে।
মাতা ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘খোকা! খোকা! কে তোদের এত ফুল দিয়াছে বাবা! খোকা!’
মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়াছিল, না ওই কবর ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল – জানে না, জাগিয়া উঠিয়াই জোহরা দেখিল, তাহার বুকে কুণ্ডলী পাকাইয়া সেই পদ্ম-গোখরো-যুগল।
জোহরা উন্মত্তের মতো চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘খোকা, আমার খোকা, তোরা এসেছিস, তোদের মাকে মনে পড়ল?’ জোহরা আবেগে সাপ দুইটিকে বুকে চাপিয়া ধরিল, সর্প দুটিও মালার মতো তাহার কন্ঠ-বাহু জড়াইয়া ধরিল।
তখন ভোর হইয়া গিয়াছে।
জোহরা দেখিল পদ্ম-গোখরোদ্বয়ের সে দুগ্ধ-ধবল কান্তি আর নাই, কেমন যেন শীর্ণ মলিন হইয়া গিয়াছে। তাহারা বারেবারে জিভ বাহির করিয়া যেন তাহাদের তৃষ্ণার কথা, ক্ষুধার কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছে, ‘মা গো বড়ো খিদে! তুমি তো ছিলে না, কে খেতে দেবে? একটু দুধ! বড়ো খিদে মা, বড়ো খিদে!’
জোহরা তাহাদের বুকে করিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, তখনও কেহ জাগিয়া উঠে নাই।
সে হেঁশেলে ঢুকিয়া দেখিল, কড়া-ভরা দুগ্ধ।
বাটিতে করিয়া দিতেই সাপ দুটি বুভুক্ষের মতো ঝাঁপাইয়া পড়িয়া দুগ্ধ পান করিতে লাগিল। যেন কত যুগযুগান্তরের ক্ষুধাতুর ওরা।
জোহরার দুই চক্ষু দিয়া তখন অশ্রুর বন্যা বহিয়া চলিয়াছে।
শাশুড়ি উঠিয়া বধূর কীর্তি দেখিয়া মূক স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন; বধূ তাঁহাকে দেখিতে পাইবামাত্র বলিয়া উঠিলেন, ‘ও মা, কী হবে, এ বালাইরা এ ছয় মাস কোথায় ছিল? যেমনই তুমি এসেছ, আর অমনই গায়ের গন্ধে এসে হাজির হয়েছে!’
জোহরা আহত স্বরে বলিয়া উঠিল, ‘ষাট, ওরা বালাই হবে কেন মা? ওরা যে আমার খোকা!’
শাশুড়ি বুঝিতে পারিলেন না, হাসিয়া বলিলেন, ‘সত্যিই ওরা তোমার খোকা বউমা। তুমি চলে যাবার পর আমরা দু একদিন ওদের দুধ দিয়েছিলাম। ও মা শুনলে অবাক হবে, ওরা দুধ ছুঁলেই না! চলে গেল! সাপও মানুষ চেনে। কলিকালে আরও কত কী দেখব!’
সাপ দুইটি তখন বোধ হয় অতিরিক্ত দুগ্ধপানবশতই নির্জীবের মতো বধূর পায়ের কাছে শুইয়া পড়িয়াছিল।
৭
সেইদিন সন্ধ্যা-রাত্রিতে বাড়ির একজন দাসী চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘ও মা গো, ভূতে ধরলে গো! জিনের বাদশা গো! জিন ভূত!’
বলিয়াই সে প্রায় অজ্ঞান হইয়া পড়িল। বাড়িময় ভীষণ হই চই পড়িয়া গেল।
আরিফের মাতা তখন আরিফকে ডাকিয়া বলিতেছিলেন, ‘হাঁ রে, বউমা যে আবার পোয়াতি, তা তো বলিসনি। ওর যে ব্যথা উঠেছে।’
আরিফ বলিতেছিল, ‘কিন্তু এখন তো ব্যথা ওঠার কথা নয় মা, মোটে তো সাত মাস!’