আরিফ জোহরাকে ডাকিয়া রাত্রির সমস্ত ব্যাপার বলিল ও ইঙ্গিতে ইহাও জানাইল যে হয়তো এ ব্যাপারে তাহারও হাত আছে।
জোহরা মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়া গেল।তাহার মূর্ছা ভাঙিবার পর আরিফ বলিল, ‘সে এখনই এ বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে! এ নরক-পুরীতে সে আর এক মুহূর্তও থাকিবে না।’
শ্বশুর-শাশুড়ি যেন পাথর হইয়া গিয়াছিল; এমনকী জোহরার মূর্ছাও আরিফই ভাঙাইল, পিতা-মাতা কেহ আসিয়া সাহায্য করিল না।
আরিফ চলিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেই জোহরা তাহার পায়ে লুটাইয়া বলিল, ‘আমাকে নিয়ে যাও, আমাকে এখানে রেখে যেয়ো না। খোদা জানেন, এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, আমি কোনো অপরাধ করিনি।’
আরিফ জোহরার কান্নাকাটিতে রাজি হইল তাহাকে কলিকাতা লইয়া যাইতে।
স্বামীর নির্দেশ মতো জোহরা পিতা-মাতাকে আর কিছুই প্রশ্ন করিল না।
৪
চলিয়া যাইবার সময় জোহরার পিতা-মাতা ছুটিয়া আসিয়া কন্যা-জামাতার হাত ধরিয়া কান্নাকাটি করিতে লাগিল, তাহারা বাসিমুখে বাড়ি ছাড়িয়া যাইতে পারে না। অন্তত সামান্য কিছু খাইয়া লইয়া তবে তাহারা যেন যায়!
আরিফ হাঁপাইয়া উঠিতেছিল, এ বাড়ির বায়ুতেও যেন কীসের পূতিগন্ধ! তবু সে খাইয়া যাইতে রাজি হইল, সে আজ দেখিবে – মানুষের ভণ্ডামির সীমা কতদুর।
জোহরা যত জিদ করিতে লাগিল, সে এ বাড়িতে আর জল স্পর্শও করিবে না, আরিফ ততই জিদ ধরিল, না, সে খাইয়াই যাইবে।
জোহরা তাহার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিল, সে কিছু খাইল না। আরিফ কিন্তু খাইবার মিনিট কয়েকের মধ্যেই বমির পর বমি করিতে লাগিল।
জোহরা আবার মূর্ছিতা হইয়া পড়িল! সে মূর্ছার পূর্বে মায়ের দিকে তাকাইয়া একটি কথা বলিয়াছিল – ‘রাক্ষুসি!’
আরিফের বুঝিতে বাকি রহিল না সে কী খাইয়াছে!
কিন্তু এখানে থাকিয়া মরিলে চলিবে না! এই মৃত্যুর ইতিহাস সে তাহার পিতা-মাতাকে বলিয়া যাইবে। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে স্টেশন অভিমুখে ছুটিল।
স্টেশনে পৌঁছিয়াই সে ভীষণ রক্ত-বমন করিতে লাগিল। রক্ত-বমন করিতে করিতেই সে প্রায় চলন্ত ট্রেনে গিয়া উঠিয়া পড়িল।
ট্রেন তখন ছাড়িয়া দিয়াছে। স্টেশন মাস্টার চিৎকার করিতে করিতে সে তখন ট্রেনে গিয়া উঠিয়া বসিয়াছে।
কামরা হইতে একজন সাহেবি পোশাক-পরা বাঙালি চেঁচাইয়া উঠিলেন, ‘এটা ফার্স্ট ক্লাস, নেমে যাও, নেমে যাও।’
আরিফ কোনো কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই আবার রক্ত-বমন করিতে লাগিল।
দৈবক্রমে যে বাঙালি সাহেবটি ট্রেনে যাইতেছিলেন, তিনি কলকাতার একজন বিখ্যাত ডাক্তার।
আরিফ অস্ফুট স্বরে একবার মাত্র বলিল, ‘আমায় বিষ খাইয়েছে, আমার–’
বলিয়াই অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেল। ডাক্তার সাহেব মফস্সলের এক বড়ো জমিদার বাড়ির ‘কলে’ গিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গে ঔষধপত্রের বাক্স ছিল। তিনি তাড়াতাড়ি ‘সার্ভেন্ট’ কামরা হইতে চাকরকে ডাকিয়া, তাহার সাহায্যে আরিফকে ভালো করিয়া শোয়াইয়া নাড়ি পরীক্ষা করিয়া ইনজেকশন দিলেন। দুই তিনটা ইনজেকশন দিতেই রোগীকে অনেকটা সুস্থমনে হইতে লাগিল। বমি বন্ধ হইয়া গেল।
ইচ্ছা করিয়াই ডাক্তার সাহেব গাড়ি থামান নাই। কারণ গাড়ি কলিকাতা পঁহুছিতে দেরি হইলে হয়তো এ হতভাগ্যকে আর বাঁচানো যাইবে না।
ট্রেন কলিকাতায় পঁহুছিলে, ডাক্তার সাহেব অ্যাম্বুলেন্স করিয়া আরিফকে হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলেন।
জোহরা সত্যসত্যই পয়মন্ত, আরিফ মৃত্যুর সহিত মুখোমুখি আলাপ করিয়া ফিরিয়া আসিল।
এদিকে জোহরা চৈতন্য লাভ করিতেই যেই সে শুনিল, তাহার স্বামী চলিয়া গিয়াছে, তখন সে উন্মাদিনীর মতো ক্রন্দন করিতে করিতে তাহার পিতার পায়ে আছাড় খাইয়া পড়িয়া বলিতে লাগিল, তাহাকে এখনই তাহার শ্বশুরবাড়ি পাঠাইয়া দেওয়া হউক।
প্রতিবেশীরা কিছু বুঝিতে না পারিয়া, প্রশ্নের পরে প্রশ্ন করিতে লাগিল।
জোহরার পিতা-মাতা সকলকে বুঝাইলেন, কন্যার সমস্ত অলংকার গত রাত্রে চুরি যাওয়ায় জামাতা পুলিশে খবর দিতে গিয়াছে, মেয়েও সেই শোকে প্রায় উন্মাদিনী হইয়া গিয়াছে।
পির সাহেবের অভিশাপের ভয়ে লোকে বাড়িতে ভিড় করিতে পারিল না, কৌতূহল দমন করিয়া সরিয়া গেল।
৫
তিন দিন তিন রাত্রি যখন কন্যা জলস্পর্শও করিল না, তখন পিতা পালকি করিয়া কন্যাকে রসুলপুরে পাঠাইয়া দিয়া পুণ্য করিবার মানসে মক্কা যাত্রা করিলেন।
আরিফও সেই দিন সকালে কলিকাতা হাসপাতাল হইতে মোটরযোগে বাড়ি ফিরিয়াছে!
আশ্চর্য! সে বাড়ি ফিরিয়া কিন্তু পিতা-মাতাকে কিছু বলিল না। এই তিন দিন ধরিয়া সে মৃত্যুর সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে অনেক কিছু ভাবিয়াছে। পিতা শুনিলে, তাহাদের খুন করিতে ছুটিবেন। তাহারা তো মরিবেই, তাহার পিতাকেও সে সেই সাথে হারাইবে। জোহরাও আত্মহত্যা করিবে!
জোহরা! জোহরা! ওই তিনটি অক্ষরে যেন বিশ্বের মধু সঞ্চিত! সে মৃত্যুকে স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, দৈবকে ভিন্ন কাহাকেও সে দোষী করিবে না। বাহিরেও না, অন্তরেও না।
সে তখনও জানে না যে, সে আবার বাঁচিয়া ফিরিয়াছে! আর কাহাকে সে অপরাধী করিবে? তাহারা যে তাহারই প্রিয়তমার পরমাত্মীয়! বাঁচিয়া উঠিয়া সে যেন নবজীবন লাভ করিয়াছে। এ যেন তার আর এক জন্ম! মৃত্যুর স্পর্শ তাহাকে সোনা করিয়া দিয়াছে।
পুত্রের মুখ দেখিয়া পিতামাতা চমকাইয়া উঠিলেন, ‘একী, এমন নীল হয়ে গেছিস কেন? একী চেহারা হয়েছে তোর?’
আরিফ শান্তস্বরে বলিল, ‘কলেরা হয়েছিল, এশিয়াটিক কলেরা। বেঁচে এসেছি এই যথেষ্ট।’