সত্যই তো এ দিকটা ভেবে দেখেনি ওরা। কিন্তু জিনের বাদশাকে যে সে নিজে চোখে দেখেছে! ওরে বাপরে ঘর সমান উঁচু মাথা, এক কোমর দাড়ি, মাথায় পাগড়ি! সে অনেক অনুরোধ করল ছেরাজ হালদারকে – হাতে পায়ে পর্যন্ত পড়ল তার, তবু তাকে নিরস্ত করতে পারল না। ছেরাজ বলল, মরে যদি তারই ছেলে মরবে, এতে নারদ আলির ক্ষতিটা কী!
শেষে যখন ছেরাজ ক্ষতিপূরণের দাবি করে চুক্তিভঙ্গের নালিশ করবে বলে ভয় দেখালে, তখন নারদ আলি হাল ছেড়ে দিলে।
চানভানুর মা এতদিন কোনো কথা বলে নি। তার মুখে আর পূর্বের হাসি রসিকতা ছিল না। কী যেন অজানা আশঙ্কায় এবং এই সব উৎপাতে সে একেবারে মুষড়ে পড়েছিল। মা-মেয়ে ঘর ছেড়ে আর কোথাও বেরোত না। জল-দানো দেখার পর থেকে মেয়েকে জল তুলে এনে দিত মা, তাতেই চানভানু নাইত। আর সে নদীমুখো হয়নি। তাবিজে কবজে চানের হাতে কোমরে গলায় আর জায়গা ছিল না। শোলা বেঁধে যেন ডুবন্ত জাহাজকে ধরে রাখার চেষ্টা!
চানও দিন দিন শুকিয়ে ম্লান হয়ে উঠেছিল। সকলের কাছে শুনে শুনে তারও বিশ্বাস হয়ে গেছিল, তার উপর জিন বা ‘আসেবের’ ভর হয়েছে। ভয়ে দুর্ভাবনায় তার চোখের ঘুম গেল উড়ে, মুখের হাসি গেল মুছে, খাওয়া-পরা কোনো কিছুতেই তার কোনো মন রইল না। কিন্তু এতো বড়ো মজার ভূত! ভূতই যদি তার ওপর ভর করবে – তবে সে ভূত আল্লারাখার কথা বলে কেন? ভূতে তো এমনটি করে না কখনও! সে নিজেই আগলে থাকে – যার ওপর ভর করে। তবে কি এ ভূত আল্লারাখার পোষা? না, সে নিজেই এই ভূত?
এত অশান্তি দুশ্চিন্তার মাঝেও সে আল্লারাখাকে কেন যেন ভুলতে পারে না। ওর অদ্ভুত আকৃতি-প্রকৃতি যেন সর্বদা জোর করে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
যত মন্দই হোক, চানদের তো কোনো অনিষ্টই করেনি সে। অতচ কী দুর্ব্যবহারই না চান করেছে ওর সাথে। ওর মনে পড়ে গেল, এর মাঝে একদিন পাড়ার অন্য একটি বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়ি আসবার সময় আল্লারাখাকে সে পড়ে ছটফট করতে দেখেছিল। রাস্তায় আর কেউ ছিল না তখন। সে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় আল্লারাখা বলেছিল, তাকে সাপে কামড়েছে! কোনখানে কামড়েছে জিজ্ঞাসা করায় আল্লারাখা তার বক্ষস্থল দেখিয়ে দিয়েছিল। সত্যই তার বুকে রক্ত পড়ছিল। চানভানুর তখন লজ্জার অবসর ছিল না। একদিন তো এই আল্লারাখাই তার প্রাণদান করেছিল নদী থেকে তুলে। সে আল্লারাখার বুকের ক্ষত-স্থান চুষে খানিকটা রক্ত বের করে ফেলে দিয়ে, আবার ক্ষতস্থানে মুখ দেবার আগে জিজ্ঞাসা করেছিল – কী সাপে কামড়েছে? আল্লারাখা নীরবে চানভানুর চোখ দুটো দেখিয়ে দিয়েছিল। তার পর কেমন করে টলতে টলতে চানভানু বাড়ি এসে মূর্ছিত হয়ে পড়েছিল আজ আর চানের সে কথা মনে নাই। কিন্তু একথা চানভানু আর আল্লারাখা ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তি কেউ জানে না।
চানভানু বুঝেছিল – প্রতারণা করে আল্লারাখা তার বুকে চানের মুখের ছোঁওয়া পেতে ছুরি বা কিছু দিয়ে বুক কেটে রক্ত বের করেছিল, সাপের কথা একেবারেই মিথ্যা, তবু সে কিছুতেই আল্লারাখা উপর রাগ করতে পারল না। যে ওর একটু ছোঁওয়া পাবার জন্য – হোক তা মুখের ছোঁওয়া – অমন করে বুক চিরে রক্ত বহাতে পারে, তার চেয়ে ওকে কে বেশি ভালোবাসে বা বাসবে! হয়তো তার হবু শ্বশুর ছেরাজ যা বলে গেল – তার সবই সত্য, তবু ওই গ্রামের লোকের চক্ষুশূল ছোঁড়াটার জন্য ওর কেন এমন করে মন কাঁদে! কেন ওকে দিনে একবার দেখতে না পেলে ওর পৃথিবী শূন্য বলে মনে হয়!
সত্যিসত্যিই তাকে জিনে পেয়েছে, ভূতে পেয়েছে – হোক সে ভূত, হোক সে জিন, তবু তো সে তাকে ভালোবাসে, তার জন্যই তো সে একবার হয় জিনের বাদশা, একবার হয় তালগাছের একানোড়ে ভূত! চানের মনে হতে লাগল, সাপে আল্লারাখাকে কামড়ায়নি, কামড়েছে তাকে, বিষ ওর মন জর্জরিত হয়ে উঠল।
মা-র মন অন্তর্যামী। সেই শুধু বুঝল মেয়ের যন্ত্রণা, তার এমন দিনে দিনে শুকিয়ে যাওয়ার ব্যথা। সেও এতদিনে সত্যকার ভূতকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও আর ফেরবার উপায় নেই। মেয়ে নিজে হাতে জবাই করতে হবে! দুর্দান্ত লোক ছেরাজ হালদার, এ সম্বন্ধ ভাঙলে সে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে না!
বাপ, মা মেয়ে তিনজনেই অসহায় হয়ে ঘটনার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল।
কিছুতেই কিছু হল না। জীবনে যে পরাজয় দেখেনি, সে আজ পরাজিত হল। জিনের বাদশা, তার গৈবী বাণী, যত রকম ভূত ছিল – একানোড়ে, মামদা, সতর চোখির মা, বেহ্মদোত্তি, কন্ধকাটা – সব মিলেও তারা পরাজয় নিবারণ করতে পারলে না! তা ছাড়া আল্লারাখার আর পূর্বের মতো সে উৎসাহও ছিল না। যে দিন চানভানু তার চাঁদমুখ দিয়ে ওর বুকের রক্ত স্পর্শ করেছিল সেই দিন থেকে তার রক্তের সমস্ত বিষ – সমস্ত হিংসা দ্বেষ লোভ ক্ষুধা – সব যেন অমৃত হয়ে উঠেছিল। তার মনের দুষ্ট শয়তান সেই একদিনের সোনার ছোঁওয়ায় যেন মানুষ হয়ে উঠেছিল। পরশমণির ছোঁওয়া লেগে ওর অন্তরলোক সোনার রং-এ রেঙে উঠেছিল। তার মনের ভূত সেই দিনই মরে গেল।
চানভানুর বিয়ে হয়ে গেল। বর তার কেমন হল, তা সে দেখতে পেলে না। দেখবার তার ইচ্ছাও ছিল না। বরও কনেকে দেখলে না ভয়ে – যদি তার ঘাড়ের জিন এসে তার ঘাড় মটকে দেয়। ভালো ভালো গুণীর সন্ধানে বর সেই দিনই বেরিয়ে পড়ল।
চানভানুর যে রাত্রে বিয়ে হয়ে গেল, তার পরদিন সকালে আল্লারাখার বাপ মা ভাই সকলে আল্লারাখাকে দেখে চমকে উঠল। তার সে বাবরি চুল নেই, ছোটো ছোটো করে চুল ছাঁটা, পরনে একখানা গামছা, হাতে পাঁচনি, কাঁধে লাঙ্গল! তার মা সব বুঝলে। তার ছেলে আর চানভানুকে নিয়ে গ্রামে যা সব রটেছে, সে তার সব জানে। মা নীরবে চোখ মুছে ঘরে চলে গেল। তার বাপ আর ভাইরা খোদার কাছে আল্লারাখার এই সুমতির জন্য হাজার শোকর ভেজল।…