সাত আট দিন ধরে যখন আর কোনো উপদ্রব হল না, তখন সবাই বললে, এইসব তন্ত্রমন্ত্রের চোটেই ভূতের পোলারা ল্যাজ তুলে পালিয়েছে। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
এদিকে – দ্বিতীয় দিনের ভৌতিক ক্রিয়াকাণ্ডের পরদিন সকালে, আল্লারাখা কলকাতার পুথি-ছাপা এক প্রেসের ঠিকানা সংগ্রহ করে সেখানে বহু মুসাবিদার পর নিম্নলিখিত চিঠি ও তার যা ছাপা হবে কপি পাঠিয়ে দিল। প্রেসের ম্যানেজারকে লিখিত চিঠিটি এই :
শ্রীশ্রীহকনাম ভরসা
মহাশয়,
আমার ছালাম জানিবেন। আমার এই লেখাখানা ভালো ও উত্তমরূপে ছাপাইয়া দিবেন। আর জদি গরিবের পত্রখানা পাইয়া ৩/৪ দিনের মধ্যে ছাপাইয়া না দিবেন আর জদি গবিলতি করেন তবে ঈশ্বরের কাছে ঢেকা থাকিবেন। আর ছাপিবার কত খরচ হয় তাহা লিখিয়া দিবেন। হুজুর ও মহাশয় গবিলতি করিবেন না। আর এমন করিয়া ছাপিয়া দিবেন চারিদিক দিয়া ফেসেং ও অতি উত্তম কাগজে ছাপিবেন। ইতি। সন ১৩৩৭ সাল ১০ বৈশাখ
আমাদের ঠিকানা
আল্লারাখা ব্যাপারী
উরফে কেশরঞ্জন বাবু। তাহার হতে পঁহচে।
সাং মহনপুর,
পোং ড্যামুড্যা
জিং ফরিদপুর। (যেখানে আরিয়লখাঁ নদী সেইখানে পঁহচে।)
চিঠির সাথে জিনের বাদশা যে গৈবী বাণী ছাপতে দিল, তা এই :
বিসমিল্লা আল্লাহো আকবর
লা এলাহা এল্লেল্লা
গায়েব
হে নারদ আলি শেখ
তোরে ও তোর বিবিরে বলিতেছি।
তোর ম্যায়্যা চানভানুরে,
চুন্ন ব্যাপারীর পোলা আল্লারাখার কাছে বিবাহ দে। তার পর তোরা যদি না দেছ তবে বহুৎ ফেরেরে পরিবি। তোরা যদি আমার এই পত্রখানা পড়িয়া চুন্নু ব্যাপারীর কাছে তোরা যদি প্রথম কছ তবে সে বলিবে কি এরে এইখানে বিবাহ দিবি। তোরা তবু ছারিছ না। তোরা একদিন আল্লারাখারে ডাকিয়া আনিয়া আর একজন মুনশি আনিয়া কলেমা পড়াইয়া দিবি।
খবরদার খবরদার
মাজগাঁয়ের ছেরাজ হালদার ইচ্ছা করিয়াছে তার পোলার জন্যে চানুভানুরে নিব। ইহা এখনও মনে মনে ভাবে। খবরদার খবরদার। খোদাতাল্লার হুকুম হইয়াছে আল্লারাখার কাছে বিবাহ দিতে। আর যদি খোদাতাল্লার হুকুম অমান্য করছ তবে শেষে তোর ম্যাইয়্যা ছেমরি দুস্কু ও জালার মধ্যে পরিবে।
খবরদার – হুঁশিয়ার – সাবধান আমার এই পত্রের উপর ইমান না আনিলে কাফের হইয়া যাইবি।
তোর আল্লারাখার কাছে বিবাহ দেছ বিবাহের শেষে স্বপনে আমার দেখা পাইবি। চানভানু আমার ভইনের লাহান। আমি উহারে মালমাত্তা দিব। দেখ তোরে আমি বারবার বলিতেছি – তোর ম্যায়ার আল্লারাখা ছেমরার কাছে শাদি বহিবার একান্ত ইচ্ছা। তবে যদি এ-বিবাহ না দেছ, তবে শেষে আলামতদেখিবি। ইতি
জিনের বাদছা
গায়েবুল্লা।
এই কপির কোনাতেও বিশেষ করে সে অনুরোধ করে দিল যেন ছাপার চারি কিনারায় ‘ফেসেং’ হয়।…
কলকাতা শহর, টাকা দিলে নাকি বাঘের দুধ পাওয়া যায়। এই গৈব বাণীও আট-দশ দিনের মধ্যে প্রেস থেকে ছাপা হয়ে এল। আল্লারাখার আর আনন্দ ধরে না।
আবার ভূতের কমিটি বসল। ঠিক হল সেই রাতেই ছাপানো গৈবী বাণী নারদ আলির বাড়িতে রেখে আসতে হবে। জিনের বাদশার সেই পোশাক পরে আল্লারাখা যাবে ওদের বাড়িতে। যদি কেউ জেগে উঠে, ওই চেহারা দেখে, তার দাঁতে দাঁত লাগতে দেরি হবে না।
সেদিন রাত্রে জিনের বাদশার গৈবী বাণী বিনা বাধায় চালের মটকা ভেদ করে চানভানুর বাড়ির ভিতরে গিয়ে পড়ল। সকাল হতে না হতেই আবার গ্রামে হই চই পড়ে গেল।
নারদ আলি ভীষণ ফাঁপরে পড়লে। জিনের বাদশার হুকুম মতে বিয়ে না দিলেই নয় আল্লারাখার সাথে, ওদিকে কিন্তু ছেরাজ হালদারও ছাড়বার পাত্র নয়। ভূত, জিন, পরি এত রটনা সত্ত্বেও ছেরাজ তার ছেলেকে এই মেয়ের সাথেই বিয়ে দেবে দৃঢ় পণ করে বসেছিল।মাজগাঁ এবং মোহনপুরের কোনো লোকই তাকে টলাতে পারে নি। সে বলে, ‘খোদায় যদি হায়াত দেয়, আমার পোলারে কোনো হালার ভূতের পো মারবার পারব না। একদিন তো ওরে মরবারই অইবো, অর কপালে যদি ভূতের হাতেই মরণ লেহা থায়ে তারে খণ্ডাইব কেডা?’
আসল কথা, ছেরাজ অতিমাত্রায় ধূর্ত ও বুদ্ধিমান। সে বুঝেছিল চানভানু বাপ-মার একমাত্র সন্তান, তার ওপর সুন্দরী বলে কোনো বদমায়েশ লোক সম্পত্তি আর মেয়ের লোভে এই কীর্তি করছে। অবশ্য, ভূত যে ছেরাজ বিশ্বাস করত না, বা তাকে ভয় করত না – এমন নয়। তবে সে মনে করছিল, যে লোকটা এই কীর্তি করছে – সে নিশ্চয় টাকা দিয়ে কোনো পিশাচ-সিদ্ধ লোককে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছে। কাজেই বিয়ে হয়ে গেলে অন্য একজন পিশাচ-সিদ্ধ গুণীকে দিয়ে এ সব ভূত তাড়ানো বিশেষ কষ্টকর হবে না! এত জমির ওয়ারিশ হয়ে আর কোন মেয়ে তার গুণধর পুত্রের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে!
ছেরাজের পুত্রও পিতার মতোই সাহসী, চতুর এবং সেয়ানা। সে মনে করেছিল, বিয়েটা হয়ে যাক – তারপর ভূতটুতগুলো ভালো করে গুণী দিয়ে ছাড়িয়ে পরে বউয়ের কাছে ঘেঁষবে।
তারা বাপ-বেটায় পরামর্শ করে ঠিক করলে – শুধু বিয়েটা হবে ওখানে গিয়ে। রুয়ৎ বা শুভদৃষ্টিটা কিছুদিন পরে হবে এবং শুভদৃষ্টির পরে ওরা বউ বাড়িতে আনবে। ‘রুয়ৎ’ না হওয়া পর্যন্ত চানভানু বাপের বাড়িতেই থাকবে।
নারদ আলি ছেরাজ হালদারকে একবার ডেকে পাঠাল তার কাছে। পাশেই গ্রাম। খবর শুনে তখনই ছেরাজ হালদার এসে হাজির হল। ছাপানো ‘গৈবী বাণী’ পড়ে সে অনেকক্ষণ চিন্তা করলে। তার পর স্থির কন্ঠে সে বলে উঠল, ‘তুমি যাই ভাব বেয়াই আমি কইতাছি – এ গায়েবের খবর না, এ ওই হালার পোলা আল্লারাখার কাজ। হালায় কোন ছাপাখানা থেইয়া ছাপাইয়া আনছে। জিনের বাদশা তোমারে ছাপাইয়া চিঠি দিব ক্যান? জিনের বাদশারে আমি সালাম করি। কিন্তু বেয়াই, এ জিনের বাদশার কাম না। ওই হালার পোলা হালার কাম যদি না অয়, আমি পঞ্চাশ জুতা খাইমু!’