কেরোসিনের ডিবাটা হাতে নিয়ে নারদ আলি বাইরে বেরিয়েই ‘আল্লাগো’ বলে, চিৎকার করে, ঘরে ঢুকে খিল লাগিয়ে দিল। চানের মা কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল – ‘কি গো, কি অইলো! কেডা?’ নারদ আলি আর উত্তর না দিয়ে ১০৫ ডিগ্রি জ্বরের ম্যালেরিয়া রুগির মতো ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কেবলই ‘কূলহুআল্লাহ’ পড়ে বুকে ফুঁ দিতে লাগল। তার মাথার চুলগুলো পর্যন্ত তখন ভয়ে শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠছে। যত হি-হি-হি-হি করে, তত ‘তৌবাআস্তাগফার’ পড়ে, তত সে আল্লার নাম নিতে যায় – কিন্তু আল্লার ‘ল’ পর্যন্ত এসে ভয়ে জিভে জড়িয়ে যায়।
চানভানুর ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে, কিন্তু ভূতের নাম শুনে সে বিছানা কামড়ে ভয়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে আছে!
অনেকক্ষণ পরে একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে নারদ আলি বলতে লাগল, – ‘আল্লারে আল্লা! (নাকে কানে হাত দিয়ে) তৌবা আস্তগ ফারুল্লা! তৌবা তৌবা! আউজবিল্লা (নাউজবিল্লা নয়।) বিসমিল্লা। আরে আমি বারাইয়া দেহি তাল গাছের লাহান একডা বুইর্যা মাথায় পগ্গ বাঁইন্দ্যা খারাইয়া আছে! দশ-হাত-লন্বা তার দাড়ি! আল্লারে আল্লা! ও জিনের বাদশা আইছিল আমাগো বারিত!’
শুনে চান এবং তার মা দুই জনেরই ভিরমি লাগবার মতো হল। উক্ত তালগাছ-প্রমাণ লন্বা বৃদ্ধ জিনের বাদশা তখনও উঠোনে দাঁড়িয়ে কিনা, তা দেখবারও সাহস হল না কারুর। পাড়ার কাউকে চিৎকার করে ডাকবার মতো স্বরও কন্ঠে অবশিষ্ট ছিল না। গলা যেন কে চেপে ধরেছে ওদের! তার ওপরে লোক ডাকলে যদি জিনের বাদশা চটে যায়! ওরে বাপরে, তাহলে আর রক্ষে আছে! তিনজনে বাতি জ্বালিয়ে বসে বসে কাঁপতে কাঁপতে আল্লার নাম জপতে লাগল!
জিনের বাদশা সে-রাত্রে আর কোনো উপদ্রব করলে না। আস্তে আস্তে জিনের বাদশা সামনের আম বাগানে ঢুকে ইশারা করতেই তিন চারটি বিচিত্র আকৃতির ভূত বেরিয়ে এল। তারা জিনের বাদশার বেশ-বাস খুলে নিতে লাগল।
সে বেশ এইরূপ ছিল! –
প্রকাণ্ড দীর্ঘ একটা বাঁশের সাথে স্বল্প দীর্ঘ আর একটা বাঁশ আড়াআড়ি করে বাঁধা, দীর্ঘ বাঁশটার আগায় একটা মালসা বসিয়ে দেওয়া; সে মালসায় নানারকম কালি দিঠে বীভৎসরকম একটা মুখ আঁকা, সেই মালসার ওপর একটা বিরাট পাগড়ি বাঁধা। মালসার মুখে পাট দিয়ে তৈরি য়্যা লম্বা দাড়ি ঝুলানো, আড়াআড়ি বাঁশটা যেন ওর হাত, সেই হাতে দুটো কাপড় পিরানের ঝোলা হাতের মতো করে বেঁধে দেওয়া; লম্বা বাঁশটার দুই দিকে দুটো সাদা ধুতি ঝুলিয়ে দেওয়া; সেই ধুতি দুটোর মাঝে দাঁড়িয়ে সেই বাঁশটা ধরে চলা। এত বড়ো লম্বা একটা লোককে রাত্রিবেলায় ওইরকমভাবে চলে যেতে দেখলে ভূতেরাই ভয় পায়, মানুষের তো কথাই নাই!
জিনের বাদশার পোশাক খুলে নেবার পর দেখা গেল – সে আমাদের আল্লারাখা!
ভূতের সর্দার আল্লারাখা তার চেলাচামুণ্ডা আসবাবপত্র নিয়ে সরে পড়ল। যেতে যেতে বলল, ‘আজ আর না, আজ জিন দেখল, কাল গায়েবি খবর হুনবো!’
সকালে গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেল – কাল রাত্রে চানভানুদের বাড়ি জিনের বাদশা এসেছিলেন। নারদ আলি বলেছিল, তালগাছের মতো লম্বা, কিন্তু গাঁয়ের লোক সেটাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে আশমান-ঠেকা করে ছাড়লে। মেয়েরা বলতে লাগল, ‘আইবো না, এত বড়ো মাইয়া বিয়া না দিয়া থুইলে জিন আইবো না?’
কেউ কেউ বলল চানভানুর এত রূপ দেখে ওর ওপর জিনের আশক হয়েছে, ওর ওপর জিনের নজর আছে। আহা, যে বেচারার বিয়ে হবে ওর সাথে, তাকে হয়তো বাসরঘরেই মটকে মারবে!
সেদিন সারাদিন মোল্লাজি এসে চানভানুর বাড়িতে কোরান পড়লেন। রাত্রে মউলুদ শরিফ হল। বলাবাহুল্য ভূতেরাও এসে মউলুদ শরিফে শরিক হয়ে শিন্নি খেয়ে গেল। সেদিন রাত্রে সোভান এবং আরও দু-একজন ওদের বাড়িতে এসে শুয়ে থাকল।
গভীর রাত্রে বাড়ির পেছনের তালগাছের একটা বাঁশি বেজে উঠল। ঘুম কারুরই হয়নি ভয়ে। সকলে জানলা দিয়ে দেখতে পেল, তালগাছটায় ওপর থেকে প্রায় বিশ হাত লম্বা কালো কুচকুচে একটা পা নিচের দিকে নামছে। খড়খড় খড়খড় করে তালগাছের পাতাগুলো নড়ে উঠল। সাথে সাথে ঝরঝর ঝরঝর করে এক রাশ ধুলোবালি তালগাছ থেকে নারদ আলি টিনের চালের উপর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পাশের ছয়-সাতটা সুপারি গাছ একসঙ্গে ভীষণভাবে দুলতে লাগল। যেন ভেঙে পড়বে! অথচ গাছে কিছু নেই! এর পরে কী হয়েছিল, তার পরদিন সকালে আর কেউ বলতে পারল না, তার কারণ ওইটুকু পর্যন্ত দেখার পর ওরা ভয়ে বোবা, কালা এবং অন্ধ হয়ে গেছিল!
এর পরেও যেটুকু জ্ঞান অবশিষ্ট ছিল, তা লোপ পেয়ে গেল – যখন একটা কৃষ্ণকায় বেড়াল তালগাছের ওপর থেকে তাদের জানালার কাছে এসে পড়ল!
সেইদিন রাত্রে ভূতেদের কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, আর ওদের ভয় দেখানো হবেনা দু চারদিন, তা হলে ওরা গাঁ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে। তালগাছ থেকে আনা ভূতের পা বা কালো কাপড়-মোড়া বংশদণ্ডটা নাড়তে নাড়তে ভূতেদের সর্দার আল্লারাখা বললে, ‘আমি এই বুদ্ধি ঠাওরাইছি!’ ভূতের দল উদগ্রীব হয়ে উঠল শুনবার জন্য।
আল্লারাখা যা বলল তার মানে – সে ঠিক করেছে কলকাতা থেকে একটা চিঠি ছাপিয়ে আনবে। আর সেই চিঠি আর একদিন স্বয়ং জিনের বাদশা নারদ আলির বাড়িতে দিয়ে আসবে। বাস, তাহলেই কেল্লা ফতে।
এইসব ব্যাপারে চানভানুর বিয়ের দিন গেল আরও মাসখানিক পিছিয়ে। নানান গ্রামের পিশাচ-সিদ্ধ মন্ত্র-সিদ্ধ গুণীরা এসে নারদ আলির বাড়ির ভূতের উপদ্রব বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। চারপাশের গ্রামে একটা হই চই পড়ে গেল।