মোহনপুরের হানিফা, আল্লারাখা চানভানুর কেশরঞ্জনবাবু – এ-সংবাদে একেবারে ‘মরিয়া হইয়া’ উঠল। ইসপার কী উসপার! তার চানভানুকে চাই-ই-চাই। সে জানত, চানভানুর বাপ-মা কিছুতেই তার সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না। কাজেই বিয়ের প্রস্তাব করা নিরর্থক। তার মাথায় তখন জৈগুন সোনাভানের কাহিনি হরদম ঘুরপাক খাচ্ছে। সে চানভানুকে হরণ করে দেশান্তরী হয়ে যাবে! কিন্তু ও পথের একটা মুশকিল এই যে, ওতে চানভানুর সম্মতি থাকা দরকার। কী করে ওর সম্মতি নেওয়া যায়?
দেখতে দেখতে দশটা দিন কেটে গেল, কিন্তু সে সুযোগ আর ঘটল না, এগারো দিনের দিন আল্লা আল্লারাখার পানে যেন মুখ তুলে চাইলেন।
এর মধ্যে কতদিন দেখা হয়েছে চানভানুর সাথে তার, কিন্তু কিছুতেই একেবারের বেশি দু-বার ওর চোখের দিকে সে তাকাতে পারেনি। যার ভয়ে সারা গ্রাম থরহরি কম্পমান, তার কেন এত ভয় করে এইটুকু মেয়েকে – আল্লারাখা ভেবে তার কূল-কিনারা পায় না। কিন্তু আর তো সময় নাই, আর তো লজ্জা করলে চলে না। কত মতলবই সে ঠাউরালে। কিন্তু কিছুতেই কোনোটা কাজে লাগাবার সুযোগ পেল না।
আজ বুঝি আল্লা মুখ তুলে চাইলেন। সেদিন সন্ধ্যায় চানভানু যখন জল নিতে গেল নদীতে, তখন নদীর ঘাট জনমানবশূন্য।
চানভানু নদীর জলে যেই ঘড়া ডুবিয়েছে – অমনি একটু দূরে ভুস করে একটা জল দানোর মুখ মালসার মতো ভেসে উঠল এবং সেই মুখ থেকে আনুনাসিক স্বরে শব্দ বেরিয়ে এল – ‘তুই যদি আল্লারাখারে ছাইর্যা আর কারেও শাদি করিস, হেই রাত্রেই তোদের ঘাড় মটকাইয়া আমি রক্ত খাইয়া আইমু!’ চানভানু ওই স্বর এবং ওই ভীষণ মুখ দেখে একবার মাত্র ‘মা গো’ বলে জলেই মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল! এই শুভ অবসর মনে করে জলদানো নদী হতে উঠে এল এবং তার মাথা থেকে নানা রঙের বিচিত্র মালসাটা খুলে নদীর জলে ডুবিয়ে দিয়ে চানভানুকে কোলে করে ডাঙায় তুলে আনলে। এ জলদানো আর কেউ নয়, এ আমাদের সেই বিচিত্রবুদ্ধি আল্লারাখা ওরফে কেশরঞ্জনবাবু!
মিনিট কয়েকের মধ্যেই চানভানুর চৈতন্য হল। চৈতন্য হতেই সে নিজেকে আল্লারাখার কোলে দেখে – লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘তুমি কোহান থ্যা আইলে।’ ঝরবার সময় বাঁশপাতা যেমন করে কাঁপে, তেমনি করে সে কাঁপতে লাগল। আল্লারাখা বললে, ‘এই দিক দিয়া যাইতেছিলাম, দেহি কেডা জলে ভাসতে আছে, দেইহ্যা ছুড্যা জলে লাফ দিয়া পরলাম, তুইল্যা দেহি তুমি! আল্লারে আল্লা, খোদায় আনছিল আমারে এই পথে, নইলে কি অইত! কী অইছিল তোমার?
দু চোখ-ভরা কৃতজ্ঞতার অশ্রু নিয়ে চানভানু আল্লারাখার মুখের দিকে চেয়ে রইল! তার পর জলদানোর বাণীগুলি বাদ দিয়ে বাকি সব ঘটনা বললে…।
আল্লারাখা যখন চানভানুকে নিয়ে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সব কথা বললে – তখন তাদের বাড়িতে হই চই পড়ে গেল। চানভানুর বাপ-মা কাঁদতে কাঁদতে প্রাণ ভরে আল্লারাখাকে আশীর্বাদ করল। আল্লারাখা তার উত্তরে শুধু চানভানুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললে, ‘কেমন! তোমার কেশরঞ্জনবাবুর পিঠ ভাঙবানি চেলা কাঠ দিয়া?’
আজ হঠাৎ যেন খুশির উথলে উঠেছিল চানভানুর মনে। এই খুশির মুখে হঠাৎ তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘খোদায় যদি হেই দিন দেয়, ভাঙবাম পিঠ!’ বলেই কিন্তু লজ্জায় তার মাটির ভিতরে মুখ লুকিয়ে মরতে ইচ্ছা করতে লাগল। ও কথার অর্থ তো আল্লারাখার কাছে অবোধ্য নয়! কিন্তু সেদিন তো খোদা দেবেন না। কুড়ি দিন পরে যে সে হালদার বাড়ির বউ হয়ে চলে যাচ্ছে! এ কী করল সে! সে দৌড়ে ঘরে ঢুকেই বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল! তার কেবলই ডুকরে ডুকরে কান্না পেতে লাগল।
আল্লারাখাও সেই মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। চানভানুর বাপ-মা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এ কী হল! কী এর মানে?
আল্লারাখা আনন্দে প্রায় উন্মাদ হয়ে নদীর ধারে ছুটে গেল। তখন চতুর্দশীর চাঁদ উঠেছে আকাশের সীমানা আলো করে। আল্লারাখার মনে হল ও চাঁদ নয়, ও চানভানু – ওরই মনের আকাশ আলো করে উঠেছে আজ সে!
রাত্রি দশটা পর্যন্ত নদীর ধারে বসে বসে তারস্বরে চিৎকার করে সে গান করলে। তারপর বাড়ি ফিরে সে ভাবতে লাগল – শুধু জলদানোর কথা নয়, জল-দানো যা যা বলেছে, সে কথাগুলো চান নিশ্চয় তার বাপ-মাকে বলেছে। কালই হয়তো ও সম্বন্ধ ভেঙে দিয়ে ওর বাপ-মা আমাদের বাড়িতে এসে বিয়ের কথা পাড়বে। আর তা যদি না করে, নদীতে যদি আর না যায়, ডাঙার ভূত তো বেঁচে আছে।
কিন্তু আরও দুটো দিন পেরিয়ে গেলেও যখন সেরকম কোনো কিছু ঘটল না, তখন আল্লারাখার বুঝতে বাকি রইল না যে, চানভানু লজ্জায় বা কোনো কারণে জলদানোর উপদেশগুলো তার বাপ-মাকে জানায়নি। তাহলে ওর বাপ-মা অমন নিশ্চিন্ত হয়ে উঠোনে বিয়ের ছানলা তুলতে পারত না। বিফলতার আক্রোশ ক্রোধে সে পাগলের মতো হয়ে উঠল। আর দেরি করলে সব হারাবে সে, এইবার ভূতেদের মুখ দিয়ে সোজা ওর বাপ-মাকেই সব কথা জানাতে হবে!
সেদিন গভীর রাত্রে একটা অদ্ভুত রকম কান্নার শব্দে নারদ আলিদের ঘুম ভেঙে গেল! মনে হল – ওদেরই উঠোনে বসে কে যেন বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। নারদ আলি মনে করলে আজও বুঝি পাশের বাড়ির সোভান তার বউকে ধরে ঠেঙিয়েছে। সেই বউটা ওদের বাড়ি এসে কাঁদছে। তবু সে একবার জিজ্ঞাসা করলে – ‘কেডা কাঁদে গো, বদনার মা নাকি’ কোনো উত্তর এল না। তেমনি কান্না।