হঠাৎ সেই উলঙ্গ নারীদের শোভাযাত্রা উঠে দাঁড়াল। তাদের কেউ একদিন, কেউ দশ মাসের পোয়াতি তাদের কালো নাভিতল উঁচু কিনা বোঝাই যায় না, কারো গর্ভ এত স্ফীত যে মনে হয় সেই গর্ভের ভারে এখুনি হুমড়ি খেয়ে পড়বে কারো-কারো প্রসব বেদনা উঠেছে। তারা দাঁড়িয়ে উঠে দুই হাতে নিজেদের চুল ছিড়ছে। কোনো-কোনো নারীর চোখের মণি প্রায় আড়ালে চলে গেছে। কারো-কারো স্তন ঝুলে পড়েছে, কারো কারো দুধের বোঁটার পাশে ঘন ছাই রঙের ছোপ ধরেছে। আবার কারো-কারো স্তনে দুধ এত বেশি জমেছে যে ফোঁটা ফোঁটা দুধ তার ফোলা পেটের ওপর পড়ে গর্ভের শিশুটিকে ঢেকে রাখা চামড়ার ওপর দিয়ে গড়িয়ে দুই উরুর মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যেন গর্ভের শিশুটি জন্মেই যাতে সাঁতার কাটতে পারে সেজন্য রমণী দুধনদী রচনা করছে।
ঠিক সেই সময় চিত্রগুপ্তের সেই বেয়ারার নেতৃত্বে যমদূতরা রাশি রাশি মৃতদেহ নিয়ে সভায় প্রবেশ করল। ইন্দ্ৰ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘একী, একী, একী, তোমরা মৃতদেহ নিয়ে স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করেছ কেন? তোমাদের যমপুরীতে কি স্থানাভাব?’
চিত্রগুপ্তের বেয়ারা হাত জোড় করে বলল, হ্যাঁ প্রভু, বড়ই স্থানাভাব। আজ পৃথিবীতে যে পরিমাণ মৃত্যু হবার ছিল, তার তেষট্টিগুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে, যমরাজার ভাগ যমরাজা রেখে বাকিটা আপনাদের পাঠিয়ে দিলেন।’
কেন? কেন?হঠাৎ মৃত্যু বাড়ল কেন?
‘প্রশান্ত মহাসাগরে খ্রিস্টমাস নামক দ্বীপখণ্ডে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে কি কালো ধোঁয়ায় আকাশ আচ্ছন্ন হতে দেখেননি?
‘দেখেছি, দেখেছি।’
‘সেই পরীক্ষার তেজস্ক্রিয় কণাপাতে—
দেখতে দেখতে যমদূতরা রাশি রাশি শবদেহ এনে জমা করতে লাগল। সেই স্তূপ ধীরে ধীরে বড় থেকে বড় হতে লাগল অবশেষে একটা পাহাড়ের মত হল। দেবগণের বাঁ পাশে বাচ্চাভরতি ফোলা পেট ন্যাংটো মেয়েরা, ডান পাশেমৃতের পাহাড় দুই পাহাড়ের গিরিবর্ত্তে দেবগণ।
পোয়াতি মেয়েদের সেই পাহাড়টা নড়ে উঠল। তারপর পিকাসোর আঁকা ‘যৌবন’ ছবির উলঙ্গ পবিত্র ভাস্বর নীলবর্ণ এক চিরকালের স্বপ্নের মত গর্বিত ভাবে দাঁড়ালা তারপর তাদের শিরা ওঠা, ক্ষয়ে-যাওয়া, অসংখ্য কর্মের অভিজ্ঞানে শালীন হাত দুটোকে নিজেদের ফোলা পেটের ওপর রাখল, যেন-বা স্নেহ জানাচ্ছে নিজের গর্ভস্থ সন্তানদের, দুগ্ধবতীদের দুগ্ধধারা দুই উরু ভেঙে, জানু ভেঙে জাহ্নবীর মত ভূমিতে নামল, তারপর সেই বিরাট পাহাড়টা ঠোঁট ফাঁক করল, তারপর তাদের পেটের ভেতর থেকে একদিনের দুদিনের তিনদিনের বীজ, একমাস দুমাস তিনমাসের জ্বণ, চারমাস পাঁচমাস ছমাসের অগঠিত দেহ, আটমাস নমাস দশমাসের পূর্ণদেহ গর্ভস্থ শিশুরা কচি কচি অস্পষ্ট কণ্ঠে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘আমরা জন্ম নেব না।’ এই চিৎকারের শব্দে সেই পোয়াতি মেয়েদের মুখে একরকমের হাসি ফুটে উঠল। সেই অগম্য অসংখ্য নারীরা ধীরে ধীরে একটিমাত্র দেহ, একটিমাত্র চরিত্র হয়ে উঠছিল। তারা তাদের হাড় জিরজিরে, ময়লা, পোকায় কাটা, ঘেয়ো পা বামনাবতারের প্রথম পদক্ষেপের মত দেবতাদের। ওপর দিলা দেবতারা পাটখড়ির পুতুলের মত ভেঙে গেল। তারপর তারা দুনিয়ার সমস্ত অজাত শিশুকে গর্ভে ধারণ করে সিংহবাহিনী দুর্গার মত নতুন অসুর বধ করতে চলল।