পাগলাঘণ্টির আওয়াজ শুনে সব দেবদেবী সভাগৃহের দিকে ছুটলেন। ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সস্ত্রীক মঞ্চের ওপর। তাঁদের প্রত্যেকের দুপাশে দুটি অপ্সরী বিরাট পাখা নিয়ে ব্যজন শুরু করলা ইন্দ্র এসে পড়তেই সভার কাজ শুরু হল। এই সভার পরিকল্পনা করেই বিশ্বকর্মার নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তিনজন আর ইন্দ্র—এই দুইপক্ষের মধ্যে কে বড় কে ছোট এই প্রশ্নের মীমাংসা না করেও সবাইকে আঁটিয়ে দিয়েছেন। দেবতাদের বাঁ দিকে আর ডান দিকে দুটো মঞ্চ, সমান উঁচু, সমান লম্বা, সমান চওড়া, সমানসংখ্যক অপ্সরীবেষ্টিত।
ইন্দ্র এসে সিংহাসনে বসে বললেন, ‘নাচফাচের ব্যাপার যা আছে সেরে নাও।’
ভরতমুনি বললেন, ‘হে সহস্ৰমার্তণ্ডময় দেবরাজ ইন্দ্র, যাঁর প্রভায়—‘
‘আরে ঐসব বিশেষণগুলো বাদ রেখে ক্রিয়াগুলো আগে করো, দেখছ না কালো ধোঁয়ায়’, শিব খেঁকিয়ে উঠলেন।
ভরত বললেন, এই বিপকালে কোন গন্ধর্ভ বা অপ্সরাই নৃত্যে সম্মত হচ্ছে না, পাছে কোনো দেব বা দেবী তাঁদের অভিশাপ দেন এবং এই প্রলয়কালে তাঁদের আবার মর্তে যেতে হয়।’
ইন্দ্র বললেন, ন্যাকামি! কেন? অভিশাপ দেয়ার পর ত আবার কাটিয়েই দেয়া হয়। যা নিয়ম, মানতেই হবে। যাও শুরু করো তাড়াতাড়ি।’
মুরজ মুরলী মৃদঙ্গ করতাল বীণা সেতার সব একসঙ্গে বেজে উঠল এবং হাস্যবিনিন্দিতবদনে জার-দিয়ে-পাকানো যাত্রাদলের সখীদের মত একদল অপ্সরা এসে নৃত্য করতে লাগল কিন্তু তাদের দৃষ্টি ছিল সভাদ্বারের দিকে। সমস্ত ঐক্যতানের মধ্যেও সেই পাথর দিয়ে থালা বাজানোর আওয়াজ প্রত্যেকের কানে এসে বাজছিল। কে জানে সেই কালো ধোঁয়া এতক্ষণ কতদূর উঠল।
বিষ্ণু শচীর কানে কানে বললেন, নাও, অভিশাপটা দিয়ে দাও।’
শচী ক্রোধে রক্তবর্ণ হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, এমন সময় একদল প্রহরী হুড়মুড় করে সভাগৃহে প্রবেশ করল। শচী ‘উঃ মাগো’ বলে বিষ্ণুর কোলে ঢলে পড়লেন। বীজনরত এক অপ্সরা পাখা ফেলে দৌড় দিল, সেই পাখায় ভরতমুনি চাপা পড়লেন নারদ তাঁর বীণা ও খড়ম। নিয়ে বাহনশালার দিকে দৌড়লেন বিষ্ণু ‘প্রাণাধিকে’ ‘প্রাণাধিকে’ বলে শচীকে ডাকতে লাগলেন। বিষ্ণু মহাদেবের কানে কানে বললেন, ‘কী ব্যাপার, স্বর্গ কি আক্রান্ত হল?
মহাদেব বললেন, ‘কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে।’
বিষ্ণু বললেন, ‘চট করে একটা শাড়ি পরে তিলোত্তমা সাজব নাকি?’
মহাদেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি আর কিছু চির-খোকাটি নও, তখন দাড়ি ওঠেনি, মানিয়ে গিয়েছিল, এখন সাজলে—’
এমন সময় মহাদেবের গালবাজানোর মত একটা বোম-বোম ধ্বনি উঠতেই বিষ্ণু বলে উঠলেন, ‘ও আবার আপনি কী শুরু করেছেন!’
শিব বললেন, ‘আমি না ত—‘
তবে?
তবে?
সেই গালবাজানোর শব্দ ধীরে ধীরে উচ্চ থেকে উচ্চতর নাদে উঠতে লাগল। এবং শেষ পর্যন্ত সমুদ্রতঙ্গের ভেঙে পড়ার মত শব্দ করে ভেঙে পড়ল সেই সভাগৃহে। এস্ত-বিক্ষিপ্ত-বিপর্যস্ত পলায়নপর অজ্ঞান দেবতারা সেই সভাগৃহে ছড়িয়ে আছেন যত্রতত্র আর অগণ্য অসংখ্য উলঙ্গ মেয়েদের এক শোভাযাত্রা সভাগৃহে প্রবেশ করল। তাদের সামনে একটা লাল ফেস্টুন। তাতে লেখা, ‘বিশ্ব গর্ভিণী সমিতি’। আর তাদের হাতে অসংখ্য পোস্টার। সেই ফেস্টুনের নীচে দেবমানব্যোঙবোপদেব—সেই জারজ উপদেবা আর সেই উলঙ্গ মেয়েদের বিরাট শোভাযাত্রার মাঝখানে নদীর জলে ফেনার মত ভাসছে সেই কয়েকটি দেবদূত। ভয়ে তারা মারাই যেত, কিন্তু নেহাত দেবতা বলে প্রেস্টিজে লাগে। সেই জারজ উপদেব শোভাযাত্ৰিণীদের বলল, তোমরা বসো।’ সঙ্গে সঙ্গে শোভাযাত্রিণীরা বসে পড়ল, পোস্টারগুলো উঁচু করে তুলে ধরে।
তারপর জারজ উপদেব দ্রুত দেবদেবীদের কাছে গিয়ে বলল, ‘এরা সব মর্তের পোয়াতি মেয়ে। আপনাদের কাছে আর্জি নিয়ে এসেছে। শিগগির নিজের নিজের আসনে ঠিক হয়ে বসুন।’
দেবদেবীরা তাড়াতাড়ি নিজ-নিজ আসনে বসলেন শচীকে স্ট্রেচারে করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মহাদেবের আদেশানুযায়ী মদনকে সভায় থাকতে দেয়া হল না। তার আবার যখন-তখন শর নিক্ষেপ করার অভ্যাস। শেষে এই পোয়াতি মেয়েদের মধ্যে কাউকে শর নিক্ষেপ করলেই সর্বনাশা
ইন্দ্র বললেন, ‘দেবমানব্যোঙবোপদেব, তুমিও দেবও বটে, মানবও বটে, তুমিই আমাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করো। বল, কেন এই নারীগণ স্বর্গে এসেছে? কেন যুগযুগান্তের নিয়ম ভঙ্গ করে এতগুলো নারী একসঙ্গে সশরীরে স্বর্গে এল?
উপদেব বলল, ‘তপস্যা করলে দর্শন দেবার জন্য আপনাদের কাউকেই আর কোনোদিন মর্তে যেতে হত না।’
‘কেন? কেন?’
‘মর্ত ধ্বংস হয়ে যাবো।’
‘কেন? কেন? কী হয়েছে মর্তের? কোনো প্রলয়? কোনো দানবের অত্যাচার?
‘সেখানে কি স্বর্গের শাসন শিথিল হয়েছে?
‘দেবদ্বিজেকি আর মর্তবাসীর বিশ্বাস নেই?
‘দেবগণ, অসুবিধা এই যে, মর্তে সময় আছে, আপনারা সময় কাকে বলে জানেনই না। সেই ঘটনাসঙ্কুল সময়কে মর্তে ইতিহাস বলে এই ইতিহাসের এক যুগসন্ধি এসেছে।’
‘যুগসন্ধি কাকে বলে?
‘গত প্রায় বিশ বৎসর ধরে পৃথিবীতে যুদ্ধ নেই, অথচ যুদ্ধের আবহাওয়া ক্রিয়াশীল। একবার ভেবে দেখুন দেবগণ, মৃত্যুর কোনো প্রত্যক্ষ কারণ নেই, তবু যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ, কাল সে প্রেতাত্ম হয়ে বাতাসে মিশে গেল। ভেবে দেখুন দেবগণ, তরণীতে বিক্ষুব্ধ বৈতরণী পারাপারের সময় একটা কানায় সব ভার দিয়ে নৌকাটাকে ডোবাবার কিনারায় নিয়ে বিশবছর চলতে থাকলে, একটিও যাত্রী কি অনাগত আশঙ্কিত মৃত্যু থেকে বাঁচার তাগিদে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দেবে না ? দেবগণ, বিশ বৎসরের অভিজ্ঞতায় যে মায়ের জানা আছে, হয়তবা গর্ভ থেকে শিশুটি মাটিতে এলে হত্যাকারী আকাশ থেকে অসংখ্য অদৃশ্য সব ছাই উড়ে এসে এসে তার সেই শিশুটাকে ছাই করে দেবে, সে মা কি প্রসবের ভূমিগামী বেদনাকে উধ্বগামী করতে চাইবে না? অথবা হে দেবগণ, স্বর্গের দেবশিশু হাওয়া-ঝরা ফুলের মতন, পৃথিবীকে ভালবেসে পৃথিবীরই শিশু হতে যদি পৃথিবীতে নেমে যেতে চান, আর অন্তরীক্ষে যদি থাকে বোমাফাটা ছাইয়ের সাগর, তবে আর-কোনো শিশু পৃথিবীতে কোনোদিন ভালবেসে জন্ম নিতে চায়? দেবগণ, এতদিন মৃত্যু ছিল খিড়কি দোর। কাল অন্ধকারে ফাঁদ পেতে, ওৎ পেতে, লোভ দেখিয়ে জীবনকে মারত, লুঠত। নিশ্চিত তবুও কুণ্ঠিত ইতিহাসে তার কুণ্ঠা কখনো ঘোচেনি। জীবনের সিংহদ্বার ভেঙেচুরে চুরমার, খান খান, ইটের সে ভগ্নস্তূপে ‘জীবন’ আজ প্রত্নের সংবাদ মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু খিড়কি দোরের সেই ওৎপাতা গুপ্তঘাতকের করদরাজ্যে জন্ম তাই প্রত্যাখ্যাত, কেউ বাঁচবে না, জন্ম নিতে চায় না।’