‘সে ত বুঝতেই পারছি, আর যখন কেউ নেই-ই তখন এ নাম আমার না হয়ে আর কার হবে? আচ্ছা বল ত, এই দেবতাগুলোর ত জিভ দিয়ে কথা সরে না, মাথায় কামধেনুর গোবর ভরা, কোন দুঃখে ওরা এত বড় বড় নাম রাখো ভুতুর বদলে যদি বেলে যায়, তবে ঐ চিত্রগুপ্ত বুড়ো ধরতে পারবে?
দেবমানব্যোঙবোপদেব চিত্রগুপ্তের সামনে এসে দাঁড়ালা চিত্রগুপ্তের টেবিলের ওপরে একটি বিরাট মানচিত্র। তার বাঁ হাতের কাছে দুটি বাক্স—একটাতে কালো ব্যাজ আঁটা আর একটাতে শাদা ব্যাজ আঁটা পিন সামনের মানচিত্র অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপের মত সরলরেখায় বিভক্ত। চিত্রগুপ্তের ডান হাতে একটি পেন্সিল এক-একজন দেব বা যমদূত ঢুকছে। তাকে কালো (যমদূতদের) বা শাদা দেবদূতদের একটা ব্যাজ দিয়ে, পৃথিবীর মানচিত্রের এক-একটা কোঠায় পেন্সিলের টিক দিচ্ছেন ও রেজিস্টারে সেই দেব বা যমদূতের নামের বিপরীতে কোন অঞ্চলে তাকে পাঠানো হল সেই অঞ্চলের নাম লিখে রাখছেন। সেই উপদেবকে দেখে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চিত্রগুপ্ত একবার রেজিস্টারের দিকে তাকালেন—কোনো নামের পাশে এন্ট্রি বাকি নেই, একবার পিনের বাক্সের দিকে তাকালেন—কোনো পিন অবশিষ্ট নেই, একবার ভূমণ্ডলের দিকে তাকালেন—কোনো অঞ্চলও বাকি নেই। তবে?
তোমার নাম?’ চিত্রগুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন।
‘বলো।’—উপদেব বেয়ারার দিকে তাকাল।
বেয়ারা নাম বলল। শুনে রিফিউজিদের ক্যাশডোল দেয়া কেরানীর মত মুখ করে, চিত্রগুপ্ত তাক থেকে রাজশেখর বসু-র ‘চলন্তিকা খুলতেই বেয়ারা নতজানু হয়ে বলল, ‘ও আর কী দেখছেন স্যার, সেই মর্তের মেয়েছেলেটা—‘
চিত্রগুপ্তের দুই ভুরুর মাঝখানের রেখাগুলি ভুরুর ওপরে উঠে গেল, তারপর কোর্টের পেশকারের মত চোখ অর্ধেক বুজে বললেন, ‘আর কোনো জায়গা খালি নেই, তোমার আজ অফ।’
উপদেব বলে উঠল, ‘আমি অফ-টফ চাই না।’
চিত্রগুপ্ত খেকিয়ে উঠলেন, ‘মানে?
বেয়ারা এসে চিত্রগুপ্তের পদচুম্বন করে বলল, ‘প্রভু, আপনি বিস্মৃত হয়েছেন যে এই উপদেবকে আপনি সংরক্ষিত রাখেন। বর্তমানে পৃথিবীতে কখনো জন্ম, কখনো মৃত্যু আকস্মিক ভাবে বেড়ে যায়—‘
চিত্রগুপ্ত যাত্রাদলের ঘুম-পাওয়া বালকের মত জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন?’
‘প্রভু, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছে, তা দমনের জন্য ও পরবর্তী মহাযুদ্ধের অস্ত্র পরীক্ষার জন্য—একসঙ্গে সহসা অনেক লোক মারা যাচ্ছে, আর কোনো কোনো দেশে নাকি মৃত্যুভয় এত বেশি বেড়ে গেছে যে, অবৈধ সন্তান উৎপাদনের মধ্য দিয়েই তারা কোনোরকমে বেঁচে থাকতে চাইছে। তাছাড়া নিত্য নৈমিত্তিক মহামারী-দুর্ভিক্ষ ত আছেই। ফলে পৃথিবীতে জন্ম ও মৃত্যুর কোনো ব্যালান্স বর্তমানে নেই। এই উপদেবকে পাঠিয়ে দিন, ইনি জন্ম বেশি দেখলে দেবদূতদের ও মৃত্যু বেশি দেখলে যমদূতদের সাহায্য করবেন।’।
চিত্রগুপ্ত বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর ফোস করে একটি নিশ্বাস পড়ল। সেই শব্দ শুনে বেয়ারা বলল, ঐ ত ‘তথাস্তু’ বলেছেন, যাও।’ দেবমানব্যোঙবোপদেব কোনো একদিন ইন্দ্রসভায় শোন। মেনকার একটি গান শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেল। চিত্রগুপ্ত ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন, দেবদূত-যমদূতরা ফেরা পর্যন্ত নিদ্রা। বেয়ারা বাসার দিকে রওনা হল।
অন্যান্য দিন এই দুপুর বেলাটায় স্বর্গে একটু মন্থরতা আসে। গাত্ৰকণ্ডুয়নরত মৃগ, প্রেমরত দেবদেবী ও নিরালায় তপস্যারত দু-চারজন সাধুসন্ন্যাসী গোছের দেবদেবী, প্রত্যেকে একটু আধটু ঝিমিয়ে নেয়।
কিন্তু সেদিন হঠাৎ ঘন কালো মেঘে সূর্য আড়ালে চলে গেলেন। একটা বিরাট জীবন্ত বৃক্ষের মত কালো ধোঁয়া মাটিতে শিকড় চাড়িয়ে হু-হু করে স্বর্গের দিকে বাড়তে লাগল। সেই ধোঁয়ার বনস্পতি বিস্তৃততর হয়ে ঊর্ধ্বে উঠতে লাগল। এত বেগে উঠতে লাগল ও এত বেশি বাড়তে লাগল যে মনে হল এই ধোঁয়ার স্কুপের মাথা স্বর্গ ছাড়িয়ে উঠবে। তারপর একমুহূর্ত বিলম্ব না করে সমগ্র পৃথিবী উপড়ে স্বর্গের কাঁধে ভেঙে পড়ে স্বর্গ ও পৃথিবী শুদ্ধ এই ব্রহ্মাণ্ডটাকে নিয়ে অতল শূন্যতার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
মদনদেবের নেতৃত্বে সাধারণত স্বর্গে অকালবসন্তেরই আবির্ভাব হয়। স্বর্গের সিংহদুয়ারে যে প্রহরী আছে, তার ও সিংহদুয়ারের ঘণ্টার শরীরে যথাক্রমে বাত ও মরচে। একমাত্র সেই প্রহরীই স্বৰ্গমুখী কালো ধোঁয়ার স্তূপকে দেখতে পেয়েছিল, আর-আর সবাই স্বর্গের ভেতর থেকে সেই কালো ধোঁয়ার ফলে অন্ধকারে খানিকটা বিস্মিত হয়েছিল মাত্রা প্রহরী প্রথমে ভেবেছিল দেবদেবীর কোনো নতুন লীলা হয়ত-বা, কিন্তু সেই কালো ধোঁয়ার স্তূপ যে প্রচণ্ড বেগে ওপরে উঠছিল তাতে তাকে দেবতাদের চেয়েও শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছিল এবং প্রহরী ভয় পেয়ে সেই বহুদিনের মরচে ধরা ঘণ্টাটা নাড়াতে লাগল। তার ফলে একটা ফাটা বাঁশের মত আওয়াজ উঠল, যেন ঐ ধোঁয়া দেখে ঘন্টাটারও গলা ভেঙে গেছে। শেষে, বিরক্ত হয়ে প্রহরী তার রান্নাঘর থেকে একটা থালা ও শিলনোড়ার নোড়া নিয়ে এসে, নোড়া দিয়ে থালায় ঠুকতে লাগল।
কোকিলের কূজন, মুগের গাত্ৰকয়ন, মৌমাছির গুঞ্জন ও দেবদেবীর যৌবনউদ্ভিন্ন হওয়ার শব্দের মাঝখানে সেই থালার আওয়াজ শুনে পঞ্চশরের মত নিরাপদ শগুলিতেই যাঁরা দিনে একবার করে মুমূর্ষ হয়ে পড়েন তাঁরা মৃত্যুমুখেই পতিত হতেন, কিন্তু তাঁদের বাপঠাকুর্দারা কেউ কেউ অমৃত খেয়েছিলেন বলে তাঁরা বেঁচে রইলেন।