মর্তের পা
মর্তে খ্রিস্টজন্মের প্রায় দুহাজার বছর ও বুদ্ধজন্মের আড়াই হাজার বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত হবার পরও রাজনীতিতে পঞ্চশীল, অশোকস্তম্ভ, ক্রিস্টমাস দ্বীপ, খ্রিস্টান ডিমোক্রেটিক পার্টি ইত্যাদি নাম ব্যবহার করে মানবজাতি এই দুই মহামানবের প্রতি আজও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে, এশিয়া-আফ্রিকা বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে, পৃথিবীর মুক্তি নামক একটা অজ্ঞাত ব্যাপার নিয়ে অন্তরীক্ষে যুদ্ধ চলছে।
স্বর্গরাজ্যে সেদিনও সকাল হয়েছে। অরুণ সূর্যদেবকে তাঁর সাত ঘোড়ার রথে চড়িয়ে দৈনন্দিন সফরে বেরিয়েছেন জয়া-বিজয়া নিজেদের বাড়ি ছেড়ে শিবের আলয়ে এসে পার্বতীকে সাজাবার জন্য ফুল তুলছেন। নন্দী-ভৃঙ্গীর একজন শিবের বলদকে ভূষি খাওয়াচ্ছেন, আর-একজন তাঁর কাঁধ পরিষ্কার করছেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বর্গ কর্মমুখর হয়ে উঠবে। তখন শচীর সদ্যনিদ্রোখিত কাজলহীন চোখ ও রক্তিমাহীন অধরোষ্ঠ, ইন্দ্রাণীর লালিমাহীন কপোল ও কুঙ্কুমবিন্দুশূন্য সঙ্গমসব ত্রুটি সংশোধিত হয়ে যবনিকা উত্তোলনের পর মঞ্চের মত দেখাবো তবে কোটি-কোটি বৎসর পূর্বের স্বর্গ থেকে আজকের স্বর্গের কোনো তফাৎ নেই। এখানে সবই অনাদি ও অনন্ত। নিজেদের কাজকর্ম শেষ করার পর দেবদেবীরা মারা যান আবার পরদিন জন্মগ্রহণ করেন। তাই একদিন গতদিনের উপসংহার বা আগামীদিনের উপক্রমণিকা নয়। স্বৰ্গ শুধু সেদিনের, সেইদিনের, বর্তমানের।
যে-সব দেবদূতদের জন্ম ও যমদূতদের মৃত্যু ঘটানোর দায়িত্ব, তারা এসে নির্দিষ্ট ঘরে অপেক্ষা করছে। চিত্রগুপ্ত এইমাত্র এসেছেন। তিনি খাতা খুলে হিসাব-নিকাশ ঠিক করে দিনের ডিউটি ভাগ করে দেবেন। প্রতিদিন একই ডিউটি। কিন্তু প্রতিদিন তাঁদের একবার করে মৃত্যু হয় বলে দেবদেবীর কিছু মনে থাকে না।
যমদূতদের চেহারাই অপেক্ষাকৃত ভাল। তাদের গায়ে আকাশ-রঙের নীল কোর্তা। যখন মর্তে নামবে, তখন আকাশের রঙের সঙ্গে মিশে যেতে পারবে ও মর্তবাসীরা দেখতে পাবে না, এইজন্যই এ সতর্কতা। কলারের দুই কোণায় মহিষের দুই শিঙ আঁকা, যমরাজার প্রতীক। মাথার চুল ঢেউ খেলানো, ঘাড়ের কাছে সমান করে ছাঁটা। দাড়িগোঁফ নির্মল। বয়স বোঝা যায় না। মর্তের হিসাবে সাতাশ-আটাশ মনে হয়। যমদূতরা এমনভাবে হাসিঠাট্টা করছিল যেন। দেবদূতদের চেহারা তারা কেয়ারের মধ্যেই আনে না।
দেবদূতদের চেহারা বালক-বালক। তাদের গায়ে কোনো পোশাক নেই, কিন্তু অভ্রের ওপর রোদ পড়লে যেরূপ দেখায়, তদ্রুপ এক জ্যোতিদ্বারা তারা আবরিতা যখন মর্তে নামবে তখন সূর্যের কিরণের সঙ্গে (ও মেঘলা দিনে কুয়াশার সঙ্গে মিশে যেতে পারবে ও মর্তবাসীরা দেখতে পাবে না এইজন্যই এই সতর্কতা তাদের বুকের ওপরে পদ্মের পাপড়ি আঁকা-ব্রহ্মার প্রতীক। মাথার চুল এলোমেলো। বয়স বোঝা যায় না। মর্তের হিসাবে কাউকেই বার বৎসরের অধিক বলে মনে হয় না। চোখেমুখে দাঙ্গার সময়কার কিশোরদের মত ভাব কথিত আছে, দেবদানব যুদ্ধের সময় বৃত্রাসুরের ভয়ে গর্ভবতী দেবীগণ ভয়ে ঐরূপ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন বলে তারপর থেকে দেবদূতদের চেহারা ও-রকম পাণ্ডুবর্ণ।
একজনকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না সে যমদূত না দেবদূতা তার হাবেভাবে একটা ডোন্ট পরোয়া ভাব। স্বর্গের কোনো দেবের ঔরসে, এক মানবীর গর্ভে এর জন্ম। তার দুঃশীলা মানবী মাতা একে স্বর্গে এনে ফেলে দিয়ে গেছে। অভিশাপেও ভয় পায় নি তখন থেকে এর জন্য ‘উপদেব’ নামক একটি নতুন শ্রেণীর পত্তন করতে হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে যখন যা বেশী হয়, এ তখন সেই কাজ করে।
‘দেবদূত নাগসেন’—চিত্রগুপ্তের দরজায় দাঁড়িয়ে বেয়ারা হাঁকল। এই বেয়ারাটা মর্তে বহু পাপ করেছিল, কিন্তু নরকে খুব ভাল ব্যবহার করায় তাকে স্বর্গের সীমান্তে হরিজন পল্লীতে থাকতে দেয়া হয়েছে।
একমাত্র ঐ উপদেব আর এই বেয়ারা—এ দুজনেরই স্মৃতি ও মন আছে। স্বর্গে আর সবাই অনাদি ও অনন্ত।
‘এই তোকে ডাকছে—’, সেই জারজ দেবদূত নাগসেনকে ধাক্কা দেয়।
নাগসেন চমকে ‘অ্যাঁ’ বলে উঠে দাঁড়ায় ও দরজার দিকে এগোয়।
কিছুক্ষণ পর বেয়ারা দরজা খুলে দিল—নাগসেন উড়ে বেরিয়ে গেল।
‘যমদূত বিল্বধর’—
‘এই বেলে, যা—’ উপদেব যমদূতদের একজনকে ধাক্কা দিল। জন্মের পরই নাকি এই যমদূত গাছ থেকে পড়া একটি বেল লুফেছিল, তাই তার এই নামা কিছুক্ষণ পর বেয়ারা দরজা খুলে। ধরল, বিল্বধর উঠে বেরিয়ে গেল।
‘দেবপুত্র উদকসম্ভব’—উপদেব একজন দেবদূতকে ধাক্কা দিলা ধাক্কা খাওয়া জায়গার হাত বোলাতে বোলাতে সে ঘরের দিকে চলে গেল। জলক্রীড়ার সময় নাকি কোন দেবীর গর্ভ থেকে উদকসম্ভব পড়ে যায়, তাই তার ঐ নাম।
চিত্রগুপ্তের বেয়ারা একজন করে দেবদূত ও একজন করে যমদূতকে ডেকে নিয়ে যেতে লাগল। দেবদূত ও যমদূতরা চিত্রগুপ্তের কাছ থেকে হুকুম নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল পৃথিবীতে জন্মমৃত্যু ঘটাতো নিজেরা জন্মের পর থেকে অবিকৃত ও অমর হয়ে থেকেও পৃথিবীর গতিকে নিয়মিত রাখতে এরাও ব্যস্ত।
ধীরে ধীরে দুদিকের বেঞ্চই খালি হয়ে গেল। বেয়ারা হাঁকল, ‘দেবমানব্যোঙবোপদেব।’