- বইয়ের নামঃ অঁহক
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সাগর পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
ইন্টার গ্যালাকটিক স্পেসশিপ
ইন্টার গ্যালাকটিক স্পেসশিপগুলির পরিচালনা নীতিমালায় তিনটি না-সূচক সাবধান বাণী আছে। স্পেসশিপের ক্যাপ্টেনকে এই তিন না মেনে চলতে হবে।
১. স্পেসশিপ কখনো নিউট্রন স্টারের বলয়ের ভেতর দিয়ে যাবে না।
২. ব্ল্যাকহোলের বলয়ের ভিতর দিয়ে যাবে না।
৩. অঁহক গোষ্ঠীর সীমানার কাছাকাছি যাবে না। ভুলক্রমে যদি চলে যায়। অতি দ্রুত বের হয়ে আসবে।
সমস্যা হল নিউট্রন স্টার এবং ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব আগেভাগে টের পাওয়া যায়। সময় মতো ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু অঁহকদের ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগেভাগে তাদের উপস্থিতি জানার কোন উপায় নেই।
অথচ অঁহকরা মহাশূন্যের বুদ্ধিমান প্রাণীদের মধ্যে সবচে দয়ালু। বিপদগ্রস্ত মহাশূন্যযানের সাহায্যের জন্যে অতি ব্যস্ত। তাদের কর্মক্ষমতাও অসাধারণ। যে কোন যন্ত্রাংশ তারা অতি দ্রুত ঠিক করতে পারে। এই অনন্ত মহাবিশ্বের যে কোন শ্রেণীর প্রাণীর যে কোন ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গপ্রতঙ্গ ঠিক করে ফেলতে পারে। তারপরেও এদের কাছে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এদেরকে ব্ল্যাকহোল কিংবা নিউট্রন স্টারের মতই বিপজ্জনক ভাবা হয়।
অঁহকদের সম্পর্কে পরিপূর্ণ কোন তথ্য কোথাও নেই। গ্যালাকটোপিডিয়াতে লেখা আছে–
অঁহক।
অতি উন্নত বুদ্ধিমত্তার প্রাণী। ছোট ছোট দলে এরা অনন্ত মহাশূন্যে ভেসে বেড়ায়। অসংখ্য বাহু বিশিষ্ট প্রাণী। এদের খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতি অজ্ঞাত। ধারণা করা হয় এরা খাদ্য গ্রহণ করে না। মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে এরা প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করে। অন্য সব বুদ্ধিমান প্রাণীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে চায়। তবে বিপদগ্রস্ত প্রাণীদের সাহায্যে অতি দ্রুত ছুটে আসে। ভগ্ন যন্ত্রাংশ ঠিক করা এবং আহত প্রাণীদের চিকিৎসায় এদের দক্ষতা সীমাহীন।
অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীদের কাছাকাছি এলে এরা নিজেদের অদৃশ্য রাখতে পছন্দ করে। এই ক্ষমতা তাদের আছে। তারা টেলিপ্যাথিক মাধ্যমেও বুদ্ধিমান প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম। আহত বুদ্ধিমান প্রাণীদের চিকিৎসা দান কালে তারা এই ক্ষমতা ব্যবহার করে আহতের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেয়। তবে নিজেদের সম্পর্কে কিছুই বলে না।
তাদের যান্ত্রিক কোন কিছু নেই। কারণ তাদের যন্ত্রের কোন প্রয়োজন নেই। মহাকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তারা ছোটাছুটি করতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে অঁহকরা অতি শান্তি প্রিয়। সিরাস নক্ষত্রের গ্রহ ভি থ্রির অতি উন্নত প্রাণী মায়রাদের একটি দল একবার অঁহকদের লক্ষ্য করে আণবিক ব্লাস্টার, লেজার-নিও ব্লাস্টার এবং পজিট্রন ব্লাস্টার নিক্ষেপ করে। সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার মতো অবস্থা তৈরি হয়। এর উত্তরে অঁহকরা তাদের যাত্রাপথ থেকে সরে যায় এবং তাদের কাছে একটি বার্তা পাঠায়। বার্তায় বলা হয়–
ধ্বংসে আনন্দ নেই।
আনন্দ সৃষ্টিতে।
অঁহকদের মোট সংখ্যা, তাদের জীবনকাল কিংবা বাসস্থান সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নি। খুব সম্ভব তাদের নির্দিষ্ট কোন বাসস্থান নেই। তাদের শরীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া এবং জৈব রসায়ন বিষয়ক কোন কিছুই জানা যায় নি। স্পেকট্রোগ্রাফিতে প্রাপ্ত সামান্য তথ্যে অনুমান করা হয় তারা মেঘ সদৃশ প্রাণী। তাদের বলয় থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে গামা রশ্মি এবং এক্স রশ্মির বিকিরণ হয়। এই বিকিরণ অনিয়মিত বলেই তাদের উপস্থিতি আগেই বোঝা যায় না।
গ্যালাকটোপিডিয়াতে অঁহকদের সম্পর্কে খারাপ কিছু নেই। মহাবিশ্বের অন্যসব বুদ্ধিমান প্রাণীদের সঙ্গেই তাদের যুক্ত করা হয়েছে। তবে তাদের স্থান হয়েছে রেড বুকে। রেড বুকে নাম ওঠার অর্থ এদের কাছে যাওয়া অতি বিপজ্জনক।
স্পেসশিপ লি-২০১
স্পেসশিপ লি-২০১ একটি সাধারণ ফেরি শিপ। এর কাজ সৌরমণ্ডলের ভেতরের গ্রহ এবং উপগ্রহ থেকে খনিজ দ্ৰব্য মঙ্গল গ্রহে নিয়ে যাওয়া। খনিজ দ্রব্য প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির সব বড় বড় কল-কারখানাই মঙ্গল গ্রহে করা হয়েছে।
স্পেসশিপ লি-২০১-এর মাল বহনের ক্ষমতা অসাধারণ। এর ইঞ্জিন। ইলেকট্রন এমিশন ইঞ্জিন। পুরনো ধরনের ইঞ্জিন হলেও ভারি ইঞ্জিন এবং কার্যকর ইঞ্জিন। সাধারণত .2c [c আলোর গতিবেগ গতিতে চলে। প্রয়োজনে এই গতিবেগ বাড়িয়ে .6c পর্যন্ত যাওয়া যায়।
লি সিরিজের স্পেসশিপ পরিচালনার জন্যে কোন মহাকাশ নাবিকের প্রয়োজন হয় না। সাধারণ এনারবিক রোবট কম্পিউটারের সাহায্যে এই কাজ সুন্দরভাবে করতে পারে।
তবে লি সিরিজের দুশর উপরের নাম্বার শিপে অবশ্যই একজন মহাকাশ নাবিক লাগে। কারণ এই সিরিজ তৈরি করা হয়েছিল মিল্কিওয়ে গ্যালিয়াম ভেতরের মাইনিং-এর জন্যে। ইলেকট্রন এমিশন টেকনোলজি ছাড়াও এই জাতীয় মহাকাশযানে হাইপার স্পেস জাম্পের ব্যবস্থা আছে। দুশ সিরিজের এটি দ্বিতীয় মহাশূন্যযান। প্রথমটি লি-২০০ মহাশূন্যে বিধ্বস্ত হয়েছিল। বিধ্বস্ত হবার কোন কারণ জানা যায় নি। ধারণা করা হয় কোন বিচিত্র কারণে মহাশূন্যযানটি হাইপার স্পেসে জাম্প দেয়। সেট কোঅর্ডিনেট না থাকায় সেটা চিরদিনের জন্যে। হারিয়ে যায়।
এক হাজার টন গ্যালিয়াম ধাতু নিয়ে মহাকাশযান লি ২০১ বৃহস্পতির একটি উপগ্রহ থেকে মঙ্গলের দিকে রওনা হয়েছে। কনট্রোল প্যানেলে যে বসে আছে তার নাম নিম। বয়স মাত্র ২৭। মেয়েটি তিন মাস আগে মহাকাশ যান পরিচালনার সার্টিফিকেট পেয়েছে। তবে ট্রেনিং পিরিয়ড এখনো শেষ হয় নি। তাকে এক হাজার ঘণ্টার একা ফ্লাইং টাইম সংগ্রহ করতে হবে। নিম এখন পর্যন্ত সংগ্রহ করেছে দুশ একুশ ঘণ্টা। আজকের ফ্লাইট শেষ হলে আরো এগারো ঘণ্টা যুক্ত হবে।
নিমের চোখ কনট্রোল প্যানেলের দিকে। তাকিয়ে থাকার কোন অর্থ হয় না। অটো পাইলট এ দেয়া আছে। আর মাত্র আটত্রিশ মিনিট এগারো সেকেন্ডে সে পৌঁছে যাবে মঙ্গলের উপগ্রহ ডিমোসের পাশে। ফিক্সড অরবিট নিয়ে অপেক্ষা করবে মঙ্গল অবতরণ অনুমতির জন্যে। সেখানেও কিছু করতে হবে না। সবই অটো পদ্ধতিতে হবে। এই কাজের জন্যে মহাকাশ নাবিকের প্রয়োজন নেই। সাধারণ মানের একজন এনারবিক রোবটই যথেষ্ট। নিমের পাশের আসনে যে রোবটটি বসে আছে সে সাধারণ মানের নয়। যে কোন মহাকাশযান সে চালাতে পারে। অতি আধুনিক হাইপার ডাইভার চালনার দক্ষতাও তার আছে। এই এনারোবিক রোবটের নাম দৃস। এরা S2 টাইপ রোবট বলেই তাদেরকে মানুষের মতো আলাদা আলাদা নাম দিয়ে সম্মান দেখানো হয়।
দৃস নিমের দিকে তাকিয়ে বিনীত গলায় বলল, মিস ক্যাপ্টেন আমি কি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি?
নিম বলল, নিশ্চয়ই পার।
দৃস বলল, আপনি কি কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ করছেন?
অস্বাভাবিকতাটা কী ধরনের?
আমাদের এই মহাকাশযানের গতি .2c থাকার কথা। প্রোগ্রাম সে রকমই করা হয়েছে। আপনার কি মনে হয় না গতি বাড়ছে?
নিম বিরক্ত গলায় বলল, সে রকম মনে হয় না। পর্দার দিকে তাকিয়ে দেখ গতি দেখানো আছে।
দৃস বলল, আপনি কি দয়া করে ভিউ ফাইন্ডারের দিকে তাকাবেন। যে কোন দুটি উজ্জ্বল তারার দিকে তাকালেই লক্ষ করবেন আমাদের মহাকাশ যানের গতি 4cর কাছাকাছি।
এটা হতেই পারে না।
আপনি ঠিকই বলেছেন এটা হতে পারে না। কিন্তু ফুয়েল কনজামশান রেটের দিকে তাকালে আপনি দেখবেন আমি যা বলছি তা ঠিক।
নিম অতি দ্রুত কয়েকটি রিডিং নিল। রিডিং থেকে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। ফুয়েল কনজামশান রিডিং .4c গতিবেগের কথাই বলে। কিন্তু এই গতিবেগে কনট্রোল প্যানেলে লালবাতি জ্বলবে। হাইপার ডাইভ প্রক্রিয়া কার্যকর হবে।
দৃস বলল, ম্যাডাম আপনি ভীত হবেন না।
নিম বলল, আমি ভীত তোমাকে কে বলল?
দৃস বলল, মহাকাশযানের গতি এখন .5c, ভীত হবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেই আমি আপনাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে ভীত না হবার জন্যে বলছি।
নিম মঙ্গলের স্পেসশিপ মনিটারিং সেলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল। যোগাযোগ করা গেল না। দৃস বলল, ম্যাডাম কোনো মহাকাশযানের গতিবেগ যদি .5c-র চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়।
এই তথ্য আমি জানি।
আপনি যদি জানেন তাহলে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন কেন?
তুমি আমাকে কী করতে বলছ?
আমি আপনাকে ভীত না হবার জন্যে বলছি।
একটু আগেই তুমি বলেছ ভীত হবার মতো ঘটনা ঘটেছে।
দৃস বলল, আমার ধারণা যে সমস্যা তৈরি হয়েছে সে সমস্যা আপনার ট্রেনিং-এর অংশ।
নিম বলল, তার মানে কী?
ট্ৰেইনি নাবিকদের জন্যে মাঝে মাঝে পরিকল্পিতভাবে সমস্যা তৈরি করা হয়। দেখার জন্যে এরা সমস্যার সমাধান কীভাবে করে।
তোমার এ রকম মনে হচ্ছে?
আমি সম্ভাবনার কথা বলছি। নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।
এই সমস্যাটি ট্রেনিং-এর অংশ তার সম্ভাবনা কত?
.30।
বল কী এত কতো সম্ভাবনা?
ত্রিশ পারসেন্ট সম্ভাবনা কম না, মিস ক্যাপ্টেন।
৭০ পারসেন্ট সম্ভাবনা যে এটা বাস্তব সমস্যা?
আপনি যথার্থ বলেছেন। মহাকাশযানের গতিবেগ বেড়েই চলেছে। ট্রেনিং-এর সময়েও গতিবেগ এত বাড়ানো হয় না। তাছাড়া এটা মাল বোঝই ফেরি শিপ।
এখন করণীয় কী?
আপনি খুব ভাল করেই জানেন এখন করণীয়।
তারপরেও তুমি আমাকে সাহায্য করে।
আপনি যদি কুলকিনারা না পান তাহলে ইমার্জেন্সি ব্রু বাটন টিপবেন। ইমার্জেন্সি বাটন টেপার পর আপনার কিছুই করার থাকবে না। কম্পিউটার মিডিসি আপনার হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে। ছোট্ট সমস্যা কিন্তু থেকেই যাবে মিস ক্যাপ্টেন।
সমস্যা কী?
যে সব ট্রেইনি নাবিক বু বাটন টেপে তাদের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। তারা আর কখনো আকাশে উড়তে পারবে না।
আমার কী করা উচিত।
আপনার ইমার্জেন্সি বাটন টেপা উচিত।
নিম ইমার্জেন্সি বাটনে চাপ দিল। প্যানেলে সবুজ আলো জ্বলে উঠল। কম্পিউটার মিডিসির ধাতব গলা শোনা গেল।
কম্পিউটার মিডিসি বলছি। আমি মহাকাশযানের কম্পিউটারের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। আমরা ক্রমবর্ধমান গতিতে এগুচ্ছি। অতি দ্রুত ত্বরণ বন্ধ করা প্রয়োজন। সেটা করা যাচ্ছে না। আয়ন ইঞ্জিনের যে ত্রুটি ধরতে পেরেছি। সেই ক্ৰটি সারানো এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।
নিম বলল, কটি কেন দেখা গেল।
এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। হাতে সময় নেই।
তুমি এখন কী সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। খুব অল্প সময়েই এই মহাকাশযান বিধ্বস্ত হবে। কারণ এটি একটি মাল বোঝই কার্গো।.6e-র গতিবেগ এ নিতে পারবে না।
আমাদের হাতে কত সময় আছে?
তিন মিনিটেরও কম।
আমার কি কিছু করণীয় আছে?
না। আপনি পোথেল থ্রি ইনজেকশন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। মৃত্যু হবে ঘুমের মধ্যে।
নিম ঠাণ্ডা গলায় বলল, অতি সুন্দর প্রস্তাবের জন্যে ধন্যবাদ।
নিমের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণ হল। ভয়াবহ বিস্ফোরণ।
অঁহকদের ছোট্ট একটা দল
অঁহকদের ছোট্ট একটা দল দ্রুত কাজ করছে। তাদের কাজ যিনি তদারক করছেন তাকে তারা মহান শিক্ষক নামে ডাকছে। কাজের প্রতিটি পর্যায়ে তারা মহান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলছে। এমনও হচ্ছে এক সঙ্গে সবাই কথা বলছে। মহান শিক্ষক একই সঙ্গে সবার কথার জবাব দিচ্ছেন।
মহান শিক্ষক বললেন, তোমরা কি আনন্দ পাচ্ছ?
একসঙ্গে সবাই বলল, আমরা খুবই আনন্দ পাচ্ছি।
আমরা কেন বেঁচে আছি।
আনন্দের জন্যে বেঁচে আছি।
আমরা কেন বেঁচে থাকব?
আনন্দের জন্যে বেঁচে থাকব।
মৃত্যু কী?
আনন্দের সমাপ্তি।
তোমরা যে মেয়েটির শরীরবৃত্তিয় ক্ষতি ঠিকঠাক করছ সে কোন্ সম্প্রদায়ের তা কি জানো?
জানি মহান শিক্ষক। সে মানবসম্প্রদায়ের।
মানবসম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য কী?
বৈশিষ্ট্যহীন একটি সম্প্রদায়। যাদের শরীরবৃত্তিয় কর্মকাণ্ড অতি দুর্বল।
দুর্বল বলছ কেন?
এরা অক্সিজেন নির্ভর একটি প্রাণী। অক্সিজেন একটি ভারি গ্যাস। ভারি গ্যাস নির্ভর প্রাণী দুর্বল হয়। হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম নির্ভর প্রাণীরা সত্যিকার অর্থেই বুদ্ধিমান। যেমন আমরা হাইড্রোজেন নির্ভর।
এর বাইরে কী আছে?
এরা অতি নিম্ন শ্রেণীর বুদ্ধিহীন প্রাণীদের মতোই খাদ্য থেকে শক্তি সগ্ৰহ করে। কাজেই তারা চিন্তা বা শিক্ষার সময় পায় না। তারা তাদের সময়ের একটি বড় অংশ ব্যয় করে খাদ্য সংগ্রহ, খাদ্য পরিপাক এবং খাদ্য বর্জনে।
ভাল বলেছ, এদের আর কী ত্রুটি আছে?
এদের সভ্যতা যন্ত্রনির্ভর সভ্যতা। এরা আমাদের মতো যন্ত্রমুক্ত না। মহান শিক্ষক আপনি বলেছেন যন্ত্রনির্ভর সভ্যতা নিম্নমানের সভ্যতা।
যে কোন বস্তুর উপর নির্ভর সভ্যতাই নিম্ন সভ্যতা। এই সত্যটি সব সময় মনে রাখবে।
মহান শিক্ষক আমরা মনে রাখব। তোমাদের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে বললা।
মেয়েটি যে যন্ত্রনে করে এসেছে সেটি সম্পূর্ণ ঠিক করা হয়েছে। যন্ত্রযানের মূল ডিজাইনে একটি ক্ৰটি ছিল। আমরা সেই ত্রুটিও ঠিক করে দিয়েছি।
কাজটা করে কি আনন্দ পেয়েছ।
মহান শিক্ষক খুবই আনন্দ পেয়েছি।
মেয়েটির অবস্থা কী?
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। মেয়েটির শরীরের যে অংশ। অক্সিজেনবাহী তরল পরিশুদ্ধ করে সেই অংশই বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলে সামান্য বেশি সময় আমরা নিয়েছি। তার জন্যে আমরা দুঃখিত মহান শিক্ষক।
কাজটা করে কি তোমরা আনন্দ পেয়েছ?
আমরা অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি। এখন আমরা আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি।
কী নির্দেশ।
মেয়েটি জ্ঞান ফিরে পাবার পর যেন অত্যন্ত আনন্দ পায় তার জন্যে কিছু কি করব? তার শরীরের কিছু পরিবর্তন? তার জন্যে মঙ্গলময় হয় এমন কিছু পরিবর্তন।
অবশ্যই করবে। আমরা উপকারী সম্প্রদায়। আমাদের কাজ দুর্বল সম্প্রদায়ের উপকার করা। তাদের ত্রুটি দূর করা। অতি দুর্বল বুদ্ধিমত্তার প্রাণীরা নিজেদের ত্রুটি ধরতে পারে না। মেয়েটির কোন কোন ত্রুটি সারাবার কথা ভাবছ?
সে মহাকাশযান চালক। মাত্র দুটি হাতে এই জটিল মহাকাশযানের সমস্ত বোতাম এবং চক্রের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমরা তাকে আরো বাড়তি দুটা হাত দিতে চাচ্ছি।
অতি উত্তম প্রস্তাব। দাও।
হাতের আঙুলের সংখ্যা পাঁচটির জায়গায় দশটি করে করতে চাচ্ছি।
এটিও ভাল প্রস্তাব। করে দাও।
মানবসম্প্রদায়ের পেছনে কোন চোখ নেই। পেছনে চোখ না থাকার কারণে সে পেছনে দেখতে পারে না। পেছনে দেখার জন্যে তাকে সমস্ত শরীর ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতে হয়। আমরা ভাবছি তার পেছনে একটি চোখ দিয়ে দেব।
জায়গাটা ঠিক করেছ?
ঘাড়ে দিতে চাচ্ছি।
দাও ঘাড়েই দাও। তবে ঘাড়ে একটি চোখ না দিয়ে দুটা চোখ দাও। মানবসম্প্রদায় সব সময় দুটা চোখ ব্যবহার করে এসেছে। সেখানে হঠাৎ করে। পেছনে একটা চোখ তার পছন্দ নাও হতে পারে।
ঠিক আছে মহান শিক্ষক, আমরা পেছনেও দুটা চোখ দিয়ে দেব।
আর কিছু কী ভাবছ?
আপনার অনুমতি পেলে আরেকটি ছোট্ট পরিবর্তন করা যায়।
বলো কী পরিবর্তন।
মানবসম্প্রদায়ের গায়ের চামড়া সবচে দুর্বল। আমরা কি একটি ধাতব আবরণ দিয়ে দেব।
না। তার প্রয়োজন দেখি না। চামড়া দুর্বল হলেও সে স্পেস স্যুট পরে। এটি যথেষ্ট মজবুত। গায়ের চামড়া ছাড়া বাকি পরিবর্তনগুলি করে দাও।
মহান শিক্ষক।
বললা।
মেয়েটি যখন তার শরীরের পরিবর্তনগুলি দেখবে তখন সে খুবই আনন্দ পাবে।
অবশ্যই আনন্দ পাবে।
মেয়েটির আনন্দের কথা ভেবেই আমাদের আনন্দ হচ্ছে।
আনন্দ মানেই বেঁচে থাকা। আমরা বেঁচে আছি। তোমাদের সবার কাজে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট।
ধন্যবাদ মহান শিক্ষক।
নিমের মহাকাশযান
নিমের মহাকাশযান মঙ্গল গ্রহের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। সে হতভম্ব হয়ে তার চারটি হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে দৃস।
নিম চোখ তুলে ছায়ার দিকে তাকাল।
দৃস বলল, মিস ক্যাপ্টেন আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা ভয়ংকর অঁহকদের হাতে পড়েছিলাম।
নিমের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে এখনো জানে না তার ঘাড়েও দুটা চোখ আছে। সেই চোখ দিয়েও পানি পড়ছে।
দৃস বলল, মিস ক্যাপ্টেন কাঁদবেন না। আপনার জন্যে একটি ভাল সংবাদ আছে।
নিম ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ভাল সংবাদটি কী?
দৃস বলল, আপনার ঘাড়ে যে দুটি চোখ আছে, সেই চোখ দুটা আসল চোখের চেয়েও অনেক অনেক সুন্দর।