অবশ্য এর পরেও উপায়ান্তর না থাকায়, বন্ধুরা কখনো কখনো মধ্যরাতে কিংবা তারো পরে ডেভিডকে বাড়ি পৌঁছাতে গেছে। কোনোবারই অভিজ্ঞতা মনোরম হয়নি। জারিনার কেমন যেন বদ্ধমূল ধারণা হয়ে যায় ডেভিডের পদস্খলনের জন্যে। এরাই দায়ী। হিংস ভাষায় এবং হিংস্রর ভঙ্গিতে সে এই বন্ধুবৎসল এবং পরোপকারী বন্ধুদের তাড়া করে যেতো। একবার ‘ডাকাত ডাকাত’ করে চেঁচিয়ে একরাত্রি তালতলা। থানায় এদের হাজহ্বাসের ব্যবস্থাও করেছিল।
সে যা হোক, এখন নামব্রত সঙের সম্মুখে বিশাল সমস্যা। প্রত্যেকবার জন্মাষ্টমীর সময় তার ঢোল করতালি কাসি সহযোগে নামগান করে পথ প্রদক্ষিণ করে। বলতে গেলে এটাই নামগান সঙের বাৎসরিক প্রধান উৎ।
এই উৎব ডেভিডকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। সবচেয়ে বড় খোলটা নিপুণ হাতে ডেভিড বাজায়। তার গানের গলাও খুবই সুরেলা। তাছাড়া দীর্ঘকায়, সুদর্শন, গৌরবর্ণ ডেভিড ওরফে দেবীদয়ালই নায়কেরই মত ওই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেয়। তখন তার চন্দনচতি ললাট, গলায় জুইফুলের মালা, সাদা অঙ্গবস্ত্র ইত্যাদি দেখে কে বলবে যে এই লোকটিই জুতোর দোকানের টাইপরা সেলসম্যান।
তা সেই ডেভিডেরই দেখা নেই এবং এবার ব্রিতি খুব দীর্ঘদিনের। দেড় দুই মাস তো হবেই। হাবিলদার বাড়ির ঠেকে এত দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ডেভিড কখনো হয়নি। কখনো কখনো বড়জোর তিন সপ্তাহ হয়েছে। কিন্তু এবার বিশেষ করে এই জন্মাষ্টমীর আগে ডেভিডের এত দীর্ঘকাল দেখা নেই, ভাবা যায় না।
শেষ যেদিন ডেভিড এসেছিল, সেদিন অবশ্য বেশ গোলমাল হয়েছিল। ডেভিডকে বাড়িতে পৌঁছা’তে যেতে হয়েছিল, সেটাও রাত দেড়টা নাগাদ প্রায় চ্যাংদোলা করে। সেদিনও অভ্যর্থনা মোটেই সুখের হয়নি। ঘরে ঢোকা মাত্র ডেভিডকে এক ঝাঁপটায় মেঝেতে চিৎ করে ফেলে জারিনা বিবি জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে পর পর চিনেমাটির পেয়ালা ছোড়ে। অব্যর্থ লক্ষ্য তার, প্রথম দুটি অনন্ত এবং অমরের কপালে লাগে, অবস্থা বুঝে বাকি দু’জন দৌড় দেয়। কিন্তু রক্ষা পায় না। অনাদির ঘাড়ে এবং অসীমের পিঠে লাগে। সবাই অল্পবিস্তর আহত হয়, অমরের কপাল কেটে যায়, নীলরতনে গিয়ে দুটো সেলাই দিতে হয়েছিল।
***
নামব্রত সঙেঘর ঠেকে বসে সবাই খুব চিন্তান্বিত। ক্যালেন্ডার দেখে হিসেব কষে বেরোলো আজ পঞ্চাশদিন ডেভিডের দেখা নেই।
এদিকে বার্ষিক উৎসবের সময় সমাগত। আর দেরি করা যায় না।
মদ্যপানে মানুষের মনে এক ধরনের অলীক সাহস সঞ্চয় হয়। রাত দশটার সময় হাবিলদার বাড়ির দোকান বন্ধ হলে রাস্তায় বেরিয়ে কিছুক্ষণ জটলা করে সবাই সঙঘবদ্ধ হয়ে ঠিক করল, ঐ দজ্জাল জারিনা বিবিকে ভয় পেলে চলবে না, আমাদের বৌয়েরাই বা ওর চেয়ে কম কিসে, ডেভিডের বাড়িতে আজ যেতেই হবে, ডেভিডকে ছাড়া তো আর নগর সঙ্কীর্তন হবে না।
কিন্তু ডেভিড কোথায়? এক মাস আগে ডেভিড মারা গেছে।
ঐ রকম লম্বাচওড়া, যুবক মানুষ। সকালবেলা বাজারে গিয়ে বাজার থেকে ফিরে থলে নামিয়ে বৌয়ের কাছে এক গেলাস জল চাইলো। জল আর খাওয়া হয়নি। সামনে বিছানার ওপরে লুটিয়ে পড়ে। আঘঘণ্টা পরে হাসপাতাল বলে হার্ট ফেল।
এ খবর তো আর অনাদি-অনন্তদের কাছে পৌঁছায়নি। মাতালদের আড্ডায় এরকম হয়। একেক জন একেক প্রান্ত থেকে আসে। তার মধ্যে কেউ একদিন হঠাৎ বরবাদ হয়ে গেলে সে খবর আড্ডায় অন্যদের কাছে এসে পৌঁছায় না।
আজ বলতে গেলে একটু সকাল-সকালই এসেছ এরা। রাত এগারোটা। পাড়ার অনেক বাড়িতেই আলো জ্বলছে। লোকজন দাওয়ায়, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় চারমূর্তি গলির মধ্যে প্রবেশ করল।
এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক সামনের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে নৈশাহার শেষে রাস্তার কুকুরদের রুটি দিচ্ছিলেন। তিনি এদের দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? কাকে চান?
অনাদি বলল, আমরা ডেভিডের বন্ধু।
অনন্ত বলল, আমরা ঐ সামনের বাড়ির ডেভিডের কাছে এসেছি।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, আপনারা কিরকম বন্ধু? জানেন না একমাস হল ডেভিড মারা গেছে।
এই সংবাদে হতভম্ব হয়ে অনাদি-অনপ্পো পিছু হটছিল। তাদের মনের মধ্যে দুটো জিনিস কাজ করছিল। একটা হল বন্ধুর মৃত্যুর জন্য শোক এবং অন্যটা হল জারিনা বিবির আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার থেকে নিষ্কৃতি জনিত স্বস্তি।
কিন্তু ইতিমধ্যে নিজের ঘরের জানালা দিয়ে এদের দেখে স্বয়ং জারিনা বিবি রাস্তায় নেমে এসেছে। এরা জারিনাকে দেখে দৌড় দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো এদের পর্যবেক্ষণে রেখেছিল এবং দৌড় দিলেই তাড়া করবে। বুঝতে পেরে, দ্রুত পা চালিয়ে পালাতে গেল।
এদের ভাবগতিক দেখে জারিনা দ্রুতপদে এগিয়ে এলো, যাবেন না। আপনারা যাবেন না। আপনাদের কাছে আমার দরকার আছে।
কিছুই বুঝতে না পেরে অনাদি-অনন্তরা দাঁড়িয়ে গেল। তবে খুব ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। জারিনা বিবির চোখেমুখে চেহারায় রাগের ভাব দেখা যাচ্ছে না।
জারিনা এদের ডেকে নিয়ে তার ঘরে বসাল। একপাশে একটা বড় খাট, তার ওপরে এক পাশে দুই পিতৃহীন নাবালক ঘুমোচ্ছে। এ পাশটায় জারিনা শোয়। সেখানে দু’জনে বসল। আর দু’জন দুটো চেয়ারে বসল, চেয়ার দুটো এবং খাটের মাঝখানে একটা ছোট গোল টেবিল।