ডেভিডের প্রধান দোষ ছিল সে মাইনে পাওয়ার পর তিনচারদিন বেপাত্তা হয়ে যেতো। তারপর সব টাকা উড়িয়ে বাড়ি ফিরতো। কোনো সংসারই এ জিনিস বরদাস্ত করতে পারে না।
জারিনা বিবির কল্যাণে ডেভিডের এই দোষটি কিঞ্চিৎ সংশোধিত হয়েছে। হাবিলদার বাড়ির ঠেকে অতর্কিতে আবির্ভূত হয়ে জারিনা ডেভিডের টুটি চেপে বাড়ি নিয়ে যেতো, সেই সঙ্গে ইয়ার বন্ধুদের যার কাছে যা মালকড়ি আছে সেটাও হস্তগত করতো।
সে সময় ঝামেলার ভয়ে ডেভিড মাসের প্রথম দিকে নামচক্রের আড্ডায় আসতো না। জারিনা বিবিও এসে তাকে খুঁজে পেতো না। জারিনা তখন বুদ্ধি করে ডেভিডের কর্মস্থলে মাসমাইনের দিনে সকাল সকাল গিয়ে উপস্থিত হতো। এ ছাড়াও জারিনা দোকানের প্রবীণ মালিককে অনুরোধ করে যেন সে না এলে কিংবা কখনো আগের দিন মাইনে দেওয়া হলে সেটা যেন ডেভিডকে না দেয়া হয়। প্রাজ্ঞ দোকানদার সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।
অবশ্য এই ঘটনার ফলে ডেভিডের যথেষ্ট সম্মানহানি হয়েছিল। দোকানের এবং আশেপাশের দোকারে অন্য কর্মচারীদের কাছে মুখ দেখানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। মনের দুঃখে সে মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়।
মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়া খুব সোজা নয়। সব মাতালই কখনো না কখনো মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়, আবার ধরে। আবার ছাড়ে, আবার ধরে। আরো জোর দিয়ে ধরে।
একই নিয়মে কয়েকদিন মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার পরে হঠাৎ করে ডেভিড আবার নামচক্রে চলে আসে। অধিকতর উদ্যমের সঙ্গে মদ্যপান, হৈচৈ শুরু করে। হাবিলদার বাড়ির ঠেক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও সে বাড়ি যেতে চায় না। আরো খাবে, আরো আরো খাবে।
এইরকম সময়ে বন্ধুরা অনেকেই তাকে বুঝে কিংবা না বুঝে তাল দেয় কিন্তু তারা সবাই ডেভিডের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারে না। রাস্তায় বেরিয়ে করতালি সহযোগে নামগানের সঙ্গে ডেভিড যখন ‘হেলিয়া দুলিয়া’ নাচে, তারা তাল রাখতে গিয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
রাত বাড়ে। দায় বাড়ে নামচক্র সঙেঘর ঠাণ্ডামাথা সদস্যদের। তারা এভাবে ডেভিডকে রাস্তায় ফেলে যেতে পারে না।
***
এককালে কলকাতার ট্রাফিক পুলিশে মাতাল স্কোয়ার্ড ছিল। এক অ্যাংলো সার্জেন্ট সাহেব লাল মোটর সাইকেলে রাত সাড়ে দশটার পর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। কোথায় কোন্ মাতাল বাড়ি ফেরেনি, তাকে বাড়ি পাঠানোই তাঁর ডিউটি। সেই সার্জেন্ট সাহেব কলকাতার পানশালার একটি অনবদ্য গল্প অমর হয়ে আছে।
(গল্পটা অন্যেরাও লিখেছেন বা বলেছেন। আমার কাণ্ডজ্ঞানেও সম্ভবত রয়েছে। তবু কাহিনীর খাতিরে আরেকবার উল্লেখ করা যেতে পারে।)
মোদো কলকাতার মধ্য নিশা। চৌরাস্তার মোড়ে দুই মাতাল পরস্পরকে জাপটিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বহুদূর থেকে এই দৃশ্য দেখে সার্জেন্ট সাহেব তার সেই লাল মোটর সাইকেল যুগ্মমদ্যপের পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন, বাবুরা বাড়ি যাও। Go Home–এর পরে বিবিরা পেটাবে।
সবাই চলে গেছে। শুধু ঐ দু’জন দাঁড়িয়ে রইলেন, চুরচুর অবস্থায় দু’জনায় দু’জনকে পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাস্তায় মধ্যখানে সম্পূর্ণ নিশ্চল। সার্জেন্ট সাহেব তার মোটর সাইকেল নিয়ে তাদের পাস ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জোর করতে লাগলেন বাড়ি যাওয়ার জন্যে। কিন্তু তাদের তো বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই, তাদের বক্তব্য, ‘United we stand, divided we fall’ অর্থাৎ একত্রে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকলেই তারা আছে, ছাড়াছাড়ি হলেই পড়ে যাবেন। বাড়ি যাওয়ার উপায় কি?
মিস্টার ডেভিড ওরফে শ্ৰীযুক্ত দেবীদয়াল ওরফে অমরের সমস্যা অনেক জটিল। অধিক মদ্যপান করলে ডেভিডের কদাচিৎ পদস্খলন হয়, সে তখন উদ্বাহু নৃত্য করে।
আর সে বাড়ি যাবেই বা কেন? সেখানে জারিনা বিবির উদ্যত ঝটা অপেক্ষা করছে।
বেচাল অবস্থায় রাত দুপুরে পাড়ার কুকুরদের বিচলিত না করে নিজের ঘরেও নিঃশব্দ প্রবেশ খুব সহজ নয়। সুতরাং যত রাতই হোক জারিনা জেগে উঠবেই এবং তারপর ওরকম অভ্যর্থনা, ঝাটা পেটা এবং অনাহার ডেভিড়ের মোটেই পছন্দ নয়। সুতরাং সে নানা কারণেই বাড়ি ফিরতে চায় না।
নামব্রত সঙেঘর বন্ধুরা উদ্যোগ নিয়ে আগে দুয়েকবার ডেভিডকে বাড়ি পৌঁছে। দিতে গেছে। কিন্তু তার পরিণতি সুখের হয়নি। অনাদি, অনরা সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনো বহন করে চলেছে।
একবার বাদলচন্দ্র জারিনার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ডেভিডকে ঘরের মধ্যে বুকে একেবারে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। জারিনা ঘরের মধ্যে অন্ধকারে, নিঃশব্দে ওঁৎ পেতে ছিল। সে মাতল ও অসতর্ক কেরামরে কোমরে আচমকা একটা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে চোর-চোর বলে চেঁচাতে থাকে।
সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘনবসতি ঘিঞ্জি ও হাফন্তি অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়িঘর থেকে পিল পিল করে লোক লাঠিবল্পম-ভোজালি-চাবুক-হাতদাবটিদা ইত্যাদি নিয়ে রে রে করে বেরিয়ে আসে। পূর্বপুরুষের বহু পুণ্যে সে যাত্রায় বাদলচন্দ্র মত্ত অবস্থাতেও আত্মপরিচয় দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল। বলা বাহুল্য, নামব্রত সঙেঘর সহযোগী যারা সেদিন তার সঙ্গে ডেভিডকে বাড়ি পৌঁছাতে গিয়েছিল, দুর্যোগের আভাস পাওয়া মাত্রই তারা দৌড়ে পালিয়েছিল।
এখনো শীতে বর্ষায় বাদলচন্দ্রের কোমরের গাঁটটা টনটন করে।