‘নামচক্র সঙঘ’ এই নাম শুনে যদি কারো মনে ধারণা হয় যে সমিতিটি সাম্প্রদায়িক তা হলে তিনি ভুল করবেন। সাম্প্রদায়িক কেন, সঙঘটি ধার্মিকও বোধহয় নয়।
সঙেঘর প্রাণপুরুষ হলো মিষ্টর ডেভিড পাল, সাতপুরুষ কিংবা ততোধিক পুরুষ ধরে তালতলাবাসী এবং এ্যাংলো। তবে ডেভিডের জীবনের আরো একটা দিক আছে। ডেভিড তার সংক্ষেপিত নাম। তার আসল নাম দেবীদয়াল, দেবীদয়াল থেকে ডেভিড হয়েছে।
দেবীদয়াল নামটা তার ঠাকুমা রেখেছিলেন, তিনি ছিলেন ঘোর বোষ্টমী। কাটোয়ার ছোট লাইনে রেলগাড়ির গার্ডসায়েব ছিলেন ডেভিডের পিতামহ। ওখান থেকেই ডেভিডের ঠাকুমাকে তিনি বিয়ে করে নিয়ে আসেন। খ্রীস্টান সংসারেও মহিলা তার বোষ্টমী সত্ত্বা রক্ষা করেছিলেন। কপালে চন্দনের রসকলি এক স্বামীর সঙ্গে গির্জায় যেনে, পালা পার্বণে, রবিবার। ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ’ করে খাটিয়ায় তুলে মৃত্যুর পরে তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল।
ডেভিড বেশ লম্বা, গায়ের রঙ ফর্সা। ইংরেজি বলতে কইতে পারে। নিউ মার্কেটে একটা বড় সুতোর দোকানে কাজ করে হেড সেলসম্যান। শীতের দিনে কোট-প্যান্ট, টাই পরে, বড়দিনে ইস্টরে সপরিবারে গির্জায় যায়। তবে তার প্রধান দুর্বলতা সে পেয়েছে তার ঠাকুমার কাছ থেকে, সে একজন কীর্তনিয়া নামগান সঙেঘর মূল স্তম্ভ।
কিন্তু এই মূল স্তম্ভটি মাঝেমধ্যেই হেলেদুলে যায়। তার কারণ ঐ কারণবারি বা মদ।
ডেভিড একেক সময় মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়, হাবিলদার বাড়িতে তাকে আর দেখা যায় না, বেশ কয়েক দিন, এমন কি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বেপাত্তা হয়ে যায়। নামগান সঙেঘর সহশিল্পীরা তার আর খোঁজ পায় না।
অবশ্য এ জন্যে ডেভিডকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। মদ্যপানে তার উৎসাহের কোনো অভাব কখনোই হয় না। সে ইচ্ছে করে হাবিলদার বাড়িতে আসে
তা নয়, তার আসা হয় না। তার আসার উপায় থাকে না তার ধর্মপত্নী জারিনার জন্যে।
জারিনার কথা কম করে বা বেশি করে, বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলা যাবে না। তার কোনো প্রয়োজন নেই। খুব বেশি বলার দরকারও নেই।
আশেপাশের বাড়ি ঘরে, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে জারিনাকে বাই অল্পবিস্তর দেখেছে,তাকে ধ্বই হাড়ে হাড়ে চেনেন।
জারিনার প্রতাপে জগৎ সংসার তটস্থ, স্বামী বেচারা ডেভিড তো তুচ্ছাতিতুচ্ছ। এমনকি হাবিলদার বাড়ি নামক প্রবল পরাক্রান্ত দিশি মদের ঠেকের দুঃসাহসী মদ্যপদের পা ঠকঠক করে কাঁপে জারিনার নাম শুনলে।
বলা বাহুল্য, মিঃ ডেভিড পালকে উদ্ধারকল্পে মিসেস জারিনা পাল বারই হানা দিয়েছে হাবিলদার বাড়ির নৈশ ঠেকে এবং সেই ব রাতে সেখানে একই সঙ্গে রামরাবণের যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্র এবং দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেছে। কিংবা পূর্বাপর বিবেচনা করে বাল যেতে পারে দনুজদলিনীর মহিষাসুর বধ পালা মঞ্চস্থ হয়েছে।
মদের ওপর, জারিনা বিবির একটা জাতক্রোধ আছে, (অজাতক্রোধও বলা যায়), কারণ তার বাবা জুয়েল মণ্ডল খিদিরপুরে ‘ওভারসিজ বেকারিজ অ্যান্ড প্রভিসন্স’ কারখানার সহকারী প্রধান পাউরুটি তৈরির কারিগর ছিলেন। জমিসাহেব নামে তার এক মদ্যপ সহকারি বন্ধুর সঙ্গে এক শীতার্ত বড়দিনের প্রভাতে বহু রুটি এবং বহুর কেক তৈরি করতে করতে জুয়েলকারিগর উক্ত বন্ধুর প্ররোচনায় কেক ও রুটি তৈরির স্টিক বা শর্করার গাদ দুই গামলা পান করেন। তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়নি, ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিল। পুরোটা পেয় ছিল না, র্ব না হলেও অনেকাংশ চোষ্য এবং লেহ্য ছিল, চুষে এবং চেটে খেতে হয়েছে।
পরিণাম ভালো হয়নি। জুয়েল মণ্ডল ঐ সপ্তাহেই নববর্ষের দিন সকালে দেহত্যাগ করেন। জারিনা তখন মাতৃগর্ভে। জারিনা জন্ম ইস্তক রিষড়ায় তার মাতুতালয়ে মানুষ হয়েছে এবং আজন্ম মদ্যপ পিতার কীর্তিকলাপের খোটা শুনে এসেছে। সুতরাং স্বামীর ওপরে সে পরবর্তীকালে প্রতিশোধ নেবে, বিশেষত মদ্যপানের ব্যাপারে, এটা স্বতঃসিদ্ধ।
তবে জারিনাবিবির লাজ-লজ্জা, সমবোধ আছে। নিতান্ত অপারগ না হলে বিবি হাবিলদার বাড়িতে হানা দিতো না।
ডেভিডের নামচক্র সঙেঘর সাঙারো, অনাদি, অনন্ত, অনিল, অক্ষয়—এরা সবাই জানে আসল দোষী ডেভিড ওরফে দেবীদয়াল ওরফে অমর।
এখানে বলে রাখা ভালো নামচক্রের সকলেরই নতুন নাম। শুধু নামগানের সময় নয় হাবিলদার বাড়ির ঠেকেও সেই নামই চালু। ডেভিড যেমন অমর, গদা মিস্ত্রি হলো অনাদি, ছিমন্ত হলো অনন্ত এবং শেষমেশ বাদলচন্দ্র হলো অক্ষয়।
নামচক্রে বাদলচন্দ্ৰই সবচেয়ে ধর্মপ্রাণ, তার পূর্ব ইতিহাসও খুব সেকুলার। এগারো বারো বছর বয়েসে ভারত বাংলাদেশ একাকার হয়ে যাওয়া এক বন্যায় সে পদ্মা বেরিয়ে রাজশাহী থেকে মুর্শিদাবাদে ভেসে গিয়েছিলো। সেটা সেই পাতাল রেলের কলকাতার ময়দান খোঁড়ার যুগ। আজিমগঞ্জের পাশে ভাগীরথী পারের গ্রামের রহমতুল্লা ছিলেন পাতাল রেলের লেবার কনট্রাক্টর। বন্যায় ভাসমান এই কিশোরকে তিনি উদ্ধার করেন, এবং তাকে পাতাল রেলের গর্ত খোঁড়ার কাজে কলকাতায় নিয়ে আসেন।
এ গল্পে বাদলচন্দ্রের কাহিনীর স্থান নেই। আমরা এখন ডেভিড এবং জারিনা বিবির কেচ্ছায় ফিরে যাচ্ছি। এবার নয়, যথাসময়ে বাদলচন্দ্র ওরফে অক্ষয়ের সঙ্গে দেখা হবে।
ডেভিড ঠিক সংসারী টাইপের লোক নয়। তার হয়তো বিয়ে করাই উচিত হয়নি। সে অবশ্য বলে যে, আমি তো বিয়ে করিনি। জারিনা আমাকে বিয়ে করেছে।