- বইয়ের নামঃ জারিনার প্রেম
- লেখকের নামঃ তারাপদ রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
জারিনার প্রেম – তারাপদ রায়
পাঠিকা ঠাকুরানি নিজগুণে ক্ষমা করবেন। মাতালের গল্প ছাড়া আমার গতি নেই।
মাতাল যেমন বারবার তার ঠেকে ফিরে যায়, তেমনি আমি ঠেকে গেলেই মাতালের গল্পে ফিরে আসি।
এক মদ্যপ মধ্যরাতে রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন, তার কপাল কেটে যায়। বাড়িতে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের কাটা জায়গায় স্টিচিং প্ল্যাস্টার লাগিয়ে সে শুতে যায়। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে তার কপালে কোথাও স্টিচিং প্ল্যাস্টার লাগানো নেই, বিছানাতেও পড়ে নেই। পরে দাড়ি কামাতে গিয়ে সে দেখে ছোট স্টিচিং প্লাস্টার আয়নার সঙ্গে লেগে আছে। তার মানে তার কপালের কাটা জায়গায় প্ল্যাস্টারটা না লাগিয়ে সে সেটা আয়নায় তার ছায়ার কপালে লাগিয়ে দিয়েছিল।
জগৎ সংসারে মাতালের মত রহস্যময় জীব আর নেই। সে একাধারে সরল ও জটিল, বলংবদ ও মারকুটে, কৃপণ ও উদার, সনাতন ও আধুনিক। প্রকৃত মদ্যপের কথাকার হতে পারেন চেকভ কিংবা শরৎচন্দ্র।
আমার দৌড় ঐ আয়না পর্যন্ত। ছায়ার কপালে স্টিকিং প্ল্যাস্টার লাগান। রক্ত মাংসের মানুষটাকে আমি মোটেই কায়দা করতে পারি না, আয়নার মধ্যের ছায়াই আমার ভরসা।
আরম্ভ
এ গল্প উত্তম বা প্রথম পুরুষে আমি লিখবো না। এর মধ্যে আমি কোথাও নেই। আমি এই কাহিনীর তথাকথিত কোনো চরিত্র নই। কিন্তু গল্পলেখক হিসেবে কিঞ্চিৎ ভূমিকা করার প্রয়োজন আছে।
নির্মদ পাঠক এবং নির্মদিনী পাঠিকাদের কাহিনীর সুবিধার্থে, দুয়েকটি মোটা তথ্য নিবেদন করি। মাতাল নিয়ে গল্প, তাই মদের ব্যাপারটা অল্প বলে নিচ্ছি। কেউ যেন ভাববেন না, প্রচুর মদ্যশক্তির জন্যে এসব জিনিস আমি ধরে ধরে জেনেছি। তা নয়, প্রথম যৌবনে অধুনালুপ্ত রাজস্ব পর্ষদের বিলীয়মান আবগারি শাখায় কয়েক বছর কাজ করে কিঞ্চিৎ জেনেছিলাম।
ছোট গল্পের পরিসরে বিস্তারিত বলা যাবে না। আমাদের এই আখ্যানের কুশীলবেরা বাংলা খান। বাংলা মানে দিশিমদ, এ যাতা দিশি মদের কথা বলছি।
দিশি মদ, বাংলা মদ নামেই সমধিক প্রচলিত। বাংলাদেশেও শুনেছি, পশ্চিমবঙ্গেও তাই সরকারি দিশি মদের পরিচয় বাংলা বলে। অবশ্য এর বাইরে বে-আইনি, বেসরকারি চোলাই দিশি মদ আছে, যাকে গ্রাহকেরা ভালোবেসে চুন্নু বলে।
সরকারি দিশি মদকে যে বাংলা মদ বলা হয় এ বিষয়ে আমার মনে একটা খটকা আছে। দিশি মদ এই বাংলাতেই বাংলা মদ, বিহারে কিন্তু বিহার মদ নয়। মাদ্রাজে মাদ্রাজ বা তামিল মদ নয়।
আরেকটা কথা উল্লেখ করে রাখি, আমাদের দেশে যে সব বিলিতি মদ তৈরি হয় সরকারি পরিভাষায় সেও দিশি মদ, কানট্রি মেড ফরেন লিকার, সংক্ষেপে (সি এম এফ এল) আর বাংলা মদ হলো কানট্রি লিকার, দিশি মদ।
বাংলা মদের দোকানের আরেকটা বিশেষত্ব হলো এ সব দোকানের কোনো নাম থাকে না। সাইনবোর্ড পর্যন্ত থাকে না। কোথাও কদাচিৎ সাইনবোর্ড থাকলে তাতে দোকানের কোনো নাম দেয়া থাকে না। সেখানে লেখা থাকে, মদের দোকান, ভেণ্ডার রামচন্দ্র সাউ কিংবা শ্যামনাথ সাধুখাঁ।
মূল কাহিনী
আপাতত যথেষ্ট হয়েছে। পাঠক-পাঠিকাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক গল্পের সুযোগে নিষিদ্ধ বিষয়ে এর চেয়ে বেশ জ্ঞানদান করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
এবার আমরা মূল গল্পে প্রবেশ করি। প্রথমেই ভ্রম সংশোধন। বাংলা মদের দোকানের নাম যে থাকে তা নয়। বাংলা মদের নামহীন দোকান সব, যেগুলোকে তার গ্রাহক অনুগ্রাহকেরা ভালোবেসে ঠেক বলে থাকে, কখনো কখনো গ্রাহকদের দ্বারস্থ গৌরবার্থে নামাঙ্কিত হয়। যেমন খালাসিটোলা, বারদুয়ারি, হাবিলদার বাড়ি, মায়ের ইচ্ছা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সব ঠেকে দু-চারজন যে বিক্ষিপ্তভাবে যায় না তা নয় কিন্তু অধিকাংশই দলবদ্ধভাবে যায়। বন্ধু বান্ধবদের একেকটা দলে চার-পাঁচ জন থেকে পনেরো-বিশজন পর্যন্ত থাকে।
***
পূর্ব কলকাতার হাবিলদার বাড়ি একটি সুপ্রাচীন বিখ্যাত ঠেক। কেন এই মদের দোকানটির নাম হাবিলদার বাড়ি সেটা কেউ জানে না। শোনা যায়, কোনোকালে কোনো হাবিলদার সাহেব বেনামে এই মদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কালক্রমে কৃতজ্ঞ গ্রাহকবৃন্দ বেনামকে স্বনামে এনে দাঁড় করিয়েছে।
এই হাবিলদারবাড়ি ঠেকের নিয়মিত খদ্দেরদের মধ্যে কয়েকটি দল আছে, তার একটি হলো বুড়ো শিবতলার নাচগানের একটি সমিতি। অবশ্য যাঁরা সন্ধ্যাবেলা এই দলের সঙ্গে বসে এই ঠেকে নেশা করেন তারা সবাই এই ধার্মিক সংঘের লোক নয়। সমিতিটির পোষাকি নাম নামব্রত সঙঘ।
মদের দোকানটির উত্তর সীমান্তে ডানদিক ঘেঁষে মুখোমুখি দুটো লম্বা বেঞ্চে সঙেঘর রাজত্ব। মধ্যে কোনো টেবিল নেই। বেঞ্চের নিচে বোতল, জল ইত্যাদি এবং সুরাপাত্র সামনের বেঞ্চের লোকটির পাশেই রাখা নিয়ম। এ-তো আর বিলিতি মদের বার নয়, সাহেবি ক্লাসও নয়। তবে অসুবিধা হয় শনিবার সন্ধ্যাবেলা, রবিবার দুপুরে। ভিড় উপচিয়ে পড়ে। হাবিলদার বাড়ি মাতালের ভিড়ে গিজগিজ করে। হৈ হট্টগোলে গমগম করে, মদ-চাট-ঘামের গন্ধে থই থই করে।
এই ঠেকে বুড়ো শিবতলা নামচক্র সঙেঘর নিয়মিত সদস্যের সংখ্যা পাঁচ-ছয় জন। কিন্তু শনিরবিবারে পনেরো বিশজনে পৌঁছে যায়। হই হই কাণ্ড হয়।