হন্হন্ করে হেঁটে প্রায় যখন গ্রামে পৌঁছে গিয়েছি, একবার কেন যেন তিনকড়ি পেছন ফিরে তাকাল। তারপরেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বলল দেখ রাম, দেখ! কী কাণ্ড!
তাকিয়ে দেখলাম সেদিকে আকাশটা অদ্ভুত নীল রঙে ভরে গিয়েছে। তীব্র আলো নয়, মৃদু জ্যোৎস্নার মত আভা। আর তার মধ্যে দিয়ে কী একটা জিনিস যেন জলার ভেতর থেকে উঠে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে বুঝতে না বুঝতে জিনিসটা আলোর পরিধির বাইরে চলে গেল। আমরা দুজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আলোটাও একটু একটু করে ম্লান হয়ে শেষে মিলিয়ে গেল।
গ্রামে ঢুকে দেখলাম বেশ হই চই শুরু হয়ে গিয়েছে, অনেক মানুষ বেরিয়ে এসেছে বাইরে। কে যেন গাড় হাতে মাঠে যাবার সময় দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে নীল আলোটা দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে লোজন ডাকে। একেবারে মিলিয়ে যাবার আগে অন্তত সাতআটজন মানুষ দেখেছে আলোটা। যারা পরে বেরিয়েছে, তারা এখন প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে বিবরণ শুনছে। বিশু ভটচাজ বলছেন—পরপর দুদিন! আর নিশ্চয় তোমরা অবিশ্বাস করবে না—এখন তো নিজের চোখে দেখলে? কালকেই তোমরা বলেছিলে আমি আফিঙের ঝেকে খেয়াল দেখেছি। আজ নিশ্চয় আর তা বলবে না? আগামীকাল কালীপূজা, রক্ষেকালীর মন্দিরে ভাল করে পূজো দাও সবাই। এসব ভাল লক্ষণ নয়—
রঘু চৌধুরী বললেন–ঠিকই। আজ হচ্ছে ভূতচতুর্দশী-ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আজ সন্ধের পর থেকে প্রেতের দল বাতাসে মিশে ঘুরে বেড়ায়। তোমরা তো কেউ আজকাল কিছু মানো না, আধুনিক যুগ এসেছে, শহরে শুনছি তেলের বদলে গ্যাসের আলো জ্বলছে রাস্তায়। এখন বুঝে দেখ বুড়োদের কথা সত্যি না মিথ্যে।
এই গোলমালে কেউ খেয়াল করেনি আমরা বাইরে থেকে এসে গ্রামে ঢুকেছি। নইলে বকাঝকা খেয়ে মরতে হত। পরের দিন কালীপূজো, কথা রইল তিনকড়ি আর আমি বিকেল তিনটে নাগাদ রক্ষাকালীর মন্দিরের সামনে দেখা করব।
পরের দিন যথাসময়ে মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখি তিনকড়ি আমার আগেই এসে হাজির হয়েছে। মন্দিরে আজ সারারাত ধরে পূজো হবে, তার প্রস্তুতি চলেছে পুরোদমে। তিনকড়ি আমাকে একদিকে টেনে নিয়ে গিলে বলল-রাম, চল আমরা জলার দিকটা। আজ একবার ঘুরে আসি। দিনের বেলা তো কোনো ভয় নেই। কাল কী দেখতে কী দেখেছি
—নীল আলোটা তো সত্যি। আমরা ছাড়াও গ্রামের কত লোকে দেখেছে—
একটু ভেবে তিনকড়ি বলল—তবু চল যাই। বেলা থাকতে থাকতে ফিরে আসব।
গতকাল অত ভয় পেয়েছিলাম, আজই আবার সেখানে রওনা হলাম দুজন মিলে। সেই বয়েসে সবই সম্ভব ছিল। তাছাড়া ঝকঝকে সূর্যের আলোয় অপ্রাকৃত ভয় থাকে না। জলার ভেতরে ঢুকে আজ প্রথমেই যেটা অনুভব করলাম তা হ’ল কাল রাত্তিরের সেই দমবন্ধ-করা ভয়ের পরিবেশটা আর নেই। কেবল দিনের আলো রয়েছে বলে নয়, অমঙ্গলের প্রভাবটাই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বাঁদিকের সরু পথটা দিয়ে হোগলাবনে ঢুকে ঘাসজমির দ্বীপে পৌঁছে আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
বড় গাছটা সেখানে নেই।
নেই মানে একেবারেই নেই। আমরা এগিয়ে গিয়ে জমি পরীক্ষা করে দেখলাম। বড় একটা গাছ উপড়ে ফেললে তো সেখানে তার চিহ্ন থাকবে, মাটিতে তার গর্ত থাকবে—কিছু নেই। দিব্যি সমান ঘাসে ছাওয়া জমি। গেল কোথায় অত বড় গাছটা? যেভাবে এসেছিল সেভাবেই কি ফিরে গিয়েছে? ওই গাছটাকেই কি কাল রাত্তিরে আমরা আকাশে উঠে যেতে দেখেছিলাম?
বললাম–তিনু, কাল আমরা আলো-আঁধারিতে ভুল দেখিনি তো? হয়ত গাছ-টাছ কিছু ছিল না, সবটাই আমাদের চোখের ভুল। হতে পারে তো, তাই না?
তিনকড়ি দৃঢ় গলায় বললনা, হতে পারে না। কারণ আমি গাছটায় হেলান দিয়ে বসেছিলাম। জিনিসটার বাস্তব ছোঁয়া পেয়েছি। তাছাড়া
শার্টের পকেট থেকে একটা সবুজরঙের ভাজকরা কী জিনিস বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল—তাছাড়া এইটে। এইটে তো আর মিথ্যে নয়, চোখের ভুল নয়—
গতকাল রাত্তিরে দেখা ভূতুড়ে গাছের একখানা পাতা।
তিনকড়ি বলল—কী ভেবে একখানা পাতা পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। নিচেই পড়ে ছিল।
আমরা দুজনে মিলে অনেক খুঁজলাম। নাঃ, আর একটাও পাতা পড়ে নেই। সমস্ত চিহ্ন নিয়ে গাছটা মিলিয়ে গিয়েছে? কেবল তিনকড়ির রেখে দেওয়া পাতাটা ছাড়া। গ্রামে ফিরে এসে অনেককে পাতাটা দেখিয়েছিলাম, কেউ চিনতে পারেনি। বহুবছর বাদে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম ওটা কী গাছের পাতা। কাশী গিয়েছিলাম বিশ্বনাথ দর্শন করতে। একদিন সেখান থেকে দেবী মহাকালীর পূজো দিতে গিয়ে পাহাড়ের কোলে জঙ্গলের মধ্যে ওই গাছ দেখি। যে পাণ্ডা আমাদের সঙ্গে ছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল—ওই বড় গাছটা? ওর নাম বাবু বুদ্ধ নারিকেল। বিহার আর উত্তরপ্রদেশের জঙ্গলে দেখা যায়–
বললাম-বাংলাদেশে হয় না?
—না বাবু। শুকনো পাথুরে মাটি ছাড়া বুদ্ধ নারিকেল জন্মায় না।
পরে অনেককে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি সত্যিই ওই গাছ বাংলায় হয় না। পাণ্ডার কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেল ফেলে আসা প্রথম যৌবনের স্মৃতি। সেই মামাবাড়ির গ্রাম, ভূতচতুর্দশীর নিকষ কালো রাত, বন্ধু তিনকড়ি। সব কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। মামারা কেউ আর বেঁচে নেই, তাদের ছেলেপুলেরাও একজন ছাড়া সবাই জীবিকার সন্ধানে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আর কখনো সে গ্রামে যাইনি। তিনকড়িও এখন কোথায় আছে কে জানে। অনেকদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।