ভয় ঠিক করছিল না, কিন্তু অন্যদিন জলার ভেতরে ঘুরে বেড়াবার সময় মনে যে সহজ ফুর্তির ভাব থাকে সেটা অনুভব করছিলাম না। পরিবেশে কেমন যেন বিষণ্ণ ভাব, কী একটা যেন ঘটতে চলেছে, সমস্ত জায়গাটা তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। মনে পড়ল আজ ভূতচতুর্দশী, দুপুরে চোদ্দশাক ভাজা দিয়ে ভাত খেয়েছি। এতক্ষণে বাড়িতে দিদিমা চোদ্দ পিদিম দেবার জন্য প্রদীপ গোছাচ্ছেন, সলতে পাকাচ্ছেন। দিদিমা বলতেন-ভূতচতুর্দশীর দিন সন্ধের পর চোদ্দজন ভূত বাতাসে ভর করে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, তাদের খপ্পরে পড়লে ভারি মুশকিল। এদিন অন্ধকার নামার পর আর কোথাও যাবিনে, ঘরে থাকবি। ভূতেদের নামও বলতেন—আরমুই, ছারমুই, পোড়ামুই, অন্তাই, দন্তাই, খন্তাই, বরী, ঠরী—আরো কী কী যেন, সবগুলো মনে পড়ছে না। বাড়িতে বসে এসব শুনলে হাসি পায়, এখানে গা ছমছম করে।
কিছুদূর হাঁটবার পর বাঁদিকে একটা সরু পথ ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ঢুকেছে। দুদিকে জল-কাদা আর নরম ভদ্ভসে জমি, মাঝখানে আট-দশ আঙুল চওড়া একটু পথ জেগে রয়েছে। জলার মধ্যে কয়েকটা ঘাসে হাওয়া জমির টুকরো দ্বীপের মত জেগে আছে তা তো আগেই বলেছি। এই পথটা তেমন একটা দ্বীপে গিয়ে শেষ হয়েছে। আমরা সাবধানে পা ফেলে ঘাসজমিটায় গিয়ে হাজির হলাম। তখন দিনের আলো পুরোপুরি নিভে রাত্তির নেমেছে।
দ্বীপটা লম্বায় কুড়ি হাত, চওড়ায় পনেরো হাত মত হবে। মাঝখানে একটা বড় গাছ ঠেলে উঠেছে ওপরদিকে। তার মোটা গুড়িতে হেলান দিয়ে তিনকড়ি বসল, আমি বসলাম মুখোমুখি। অমাবস্যার রাত্তিরেও নক্ষত্রদের থেকে চুইয়ে আসা ক্ষীণ একটু আলোর আভাস থাকে, সে আলো অন্ধকার দূর করে না, পরিবেশকে আরো রহস্যময় করে তোলে।
তিনকড়ি বলল—আয়, নিধুবাবুর একখানা গান ধরা যাক। সেই যে গানটা যে খাতনা যতনে, আমার মনই জানে। গাইবি? নে, শুরু কর
আমার গাইতে ইচ্ছে করছিল না। তিনকড়ি বেশ ভাল গান জানত, সে একাই গান ধরল। হঠাৎ আমার মনে হল তিনকড়ি আসলে ভয় পেয়েছে। প্রথমে সাহস দেখিয়ে এখন সে ভয়টা স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে। গান গাওয়াটা প্রকৃতপক্ষে তার ভয় কাটানোর চেষ্টা। কিন্তু কেন ভয় পেল তিনকড়ি? পরিবেশের অদ্ভুত বিষণ্ণতা আর দমচাপা ভাবটা কি সে ধরতে পেরেছে?
দু-একলাইন গাইবার পর তিনকড়ি থেমে গিয়ে আমাকে বলল—গতকাল এই জলার দিকে অনেক রাত্তিরে একরকম আশ্চর্য আলো দেখতে পাওয়া গিয়েছে, জানিস?
—আলো? কী রকম আলো? এতক্ষণ বলিসনি তো
—এমনিই বলিনি। আমাদের গ্রামের অনেকেই দেখেছে। আজ সকালে মধু মিত্তির, হারাধন মজুমদার আর বিশু খুড়ো আলোচনা করছিল পথে দাঁড়িয়ে, তাই শুনছিলাম।
—কী বলছিল? নিজেরা দেখেছে?
—মধু মিত্তির আর বিশু খুড়ো দেখেছে। নীলচে মত আলো, আকাশ থেকে গোলার মত নেমে এসে মাটির কাছে দপ্ করে জ্বলে উঠে অনেকখানি জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। হারাধন মজুমদার বলছিল কাল রাতে এই জলায় ডাইনিদের চাতর বসেছিল
-সে আবার কী?
-চাতর মানে আসর। দূর দূর দেশ থেকে ডাইনিরা গাছ চালিয়ে উড়ে আসে। তারপর সারারাত ধরে তাদের সভা চলে। ওই সভাকেই বলে চাতর। গাছ-চালা কাকে বলে জানিস তো? কোনো বড় গাছের ডালে বসে ডাইনিরা হুকুম করে–অমুক জায়গায় চল। অমনি সে গাছ আকাশে উড়ে সেই জায়গায় গিয়ে হাজির হয়। উড়তে উড়তে গাছ যখন মাটির কাছে নেমে এসে লেগে বসে, তখন ওইরকম দ করে নীল আলো জ্বলে ওঠে। আমি অবশ্য এসব বিশ্বাস করি না-ওরা বলছিল, আমি শুনলাম—এই আর কী। বিশু খুড়ো আবার সন্ধের পর আফিং খায়। বুঝতেই পারছিস–
কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে তিনকড়ি একবার ওপরদিকে তাকাল, কী একটা জিনিস যেন তার মনে পড়ে গিয়েছে। তারপর সোজা হয়ে বসে পেছন ফিরে সে গাছটায় হেলান দিয়ে দিল, তার মোটা গুড়িতে একবার হাত বোলালো। এবার সে ঘুরে আমার দিকে যখন তাকাল, সেই অল্প আলোতেও দেখলাম তার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, ভয় পেলে মানুষের যেমন হয়।
বললাম—কী রে, কী হল তোর? নিজের গল্পে নিজেই ভয় পেলি নাকি?
ফিসফিস করার মত গলায় তিনকড়ি বলল—রাম, এই গাছটা কোথা থেকে এল? এটা তো আগে কখনো দেখিনি। তাছাড়া কী গাছ এটা?
এবার আমিও অবাক হয়ে গাছটার দিকে তাকালাম। সত্যিই তো, এই জমির টুকরোটায় মোটামুটি বড় গাছ বলতে একটা গাব আর একটা মাঝারি তেঁতুল গাছ বরাবর দেখে এসেছি। সে দুটো তো ওই যথাস্থানে দেখা যাচ্ছে। তাহলে বাড়তি এটা আবার কোথা থেকে এল? গাছটাই বা কী জাতের? আমরা গ্রামের ছেলে, সবরকম গাছই চিনি। বড় বড় শালগাছের মত পাতাওয়ালা এটা কোন গাছ? মাটি থেকে বিরাট মোটা গুঁড়ি সোজা আকাশের দিকে উঠেছে, বিশেষ জটিল ডালপালা নেই। অনেকটা ওপরে কিছু শাখাপ্রশাখা এদিক-ওদিক ছড়িয়েছে, তাতে থালার মত বড় বড় গোল গোল পাতা। দেখলেই মনে হয়—এ বাংলাদেশের গাছ নয়!
তিনকড়ি একইরকম ভয় পাওয়া গলায় বললভেবে দেখ, দিনসাতেক আগেও এখানে বসে আমরা আড্ডা দিয়ে গিয়েছি, এই গাছটা তো দেখিনি। এখানে কেন, গ্রামের ত্রিসীমানায় এমন গাছ দেখেছিস কখনো? এ হল ভিনদেশের গাছ–
তারপর কাপাকাপা গলায় বলল-রাম, বিশু খুড়োরা ঠিকই দেখেছিল। এখানে ডাইনির চাতর হয়েছে কাল। এই গাছ তারাই উড়িয়ে এনেছে। চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই—
কী করে যে ফিরে এলাম তা আর তোমাদের কী বলব! চেনা জায়গা, ছোটবেলা থেকে খেলা করে মানুষ হয়েছি ওই জায়গায়, কিন্তু সেদিন যেন কেবলই পথ হারিয়ে ফেলতে লাগলাম। যেদিকেই যাই, দেখি বেরুবার পথ নেই। রাস্তা আবার ঘুরে একই বিন্দুতে এসে হাজির হয়েছে। রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, বুঝলে? অত্যন্ত আবছা তারার আলো, লম্বা ঘাসের জঙ্গল, একটু পা ফেলতে ভুল হলেই কোমর পর্যন্ত কাদায় গেঁথে যাবার সম্ভাবনা, তার সঙ্গে হেমন্তকালের অস্বচ্ছ কুয়াশার পাক খাওয়া—সব মিলিয়ে যেন একটা ভয়ের স্বপ্ন। কোনোরকমে জলাভূমির বাইরে শক্ত জমিতে এসে যখন পা দিলাম তখন। আমরা দুজনেই ঘামছি।