বাবা মৃদু হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি আকুল হয়ে বাবার হাত জড়িয়ে ধরলাম। একেবারে বাস্তব রক্তমাংসের দেহ, কোন ফাঁকি নেই। আঃ, কতদিন পরে বাবাকে দেখছি! আমার সমস্ত মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল। বাবা বললেন—দেবু, আমি তোকে সেই যেখানে যাবার কথা ছিল, সেইখানে বেড়াতে নিয়ে যাবো বলে এসেছি। চল, আমার সঙ্গে যাবি–
আমি বললাম—পাখি দেখতে বাবা? পশ্চিমের মাঠে?
—না, অন্য জায়গায়। আমার সঙ্গে যেতে ভয় করবে না তো?
আমি কেঁদে ফেলে বললাম—আমি যে আর চলতে পারি না বাবা, বিছানা থেকে উঠতে পারি না–
—তোকে উঠতেও হবে না। হাঁটতেও হবে না। আমি তোকে কোলে করে নিয়ে যাবো। তুই তার জন্য তৈরি হ—
তারপর আবার মিষ্টি হেসে বললেন—দেবু, সেই অদ্ভুত পাখিটা তোর তাহলে এখনো দেখতে ইচ্ছে করে?
আমি যেন আবার শিশু হয়ে গিয়েছি। বললাম—করে।
বাবা বললেন—বেশ, দেখাচ্ছি তোকে। জানালার দিকে তাকা।
বাবার হাত ধরে থেকেই ডানদিকের জানলাটার দিকে তাকালাম। ডানা ঝাপটানোর শব্দ করে জানালার ঠিক বাইরে বাতাবি লেবু গাছের ডালে আশ্চর্য এক পাখি কোথা থেকে উড়ে এসে বসল। কী অপূর্ব রং-এর বাহার তার! কেমন চুনির মত লাল চোখ! অমন পাখি কেউ কখনো দেখেনি ঠাকুরমশাই, স্বর্গের এই বিচিত্র পাখি বাবাই তো আমায় দেখালেন। আমি খুশি হয়ে বাবার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম।
বাবা নেই। আমি অমরজীবনের হাত ধরে রয়েছি।
এই আমার কাহিনী ঠাকুরমশাই। এই কথা বলবার জন্যই আমি আপনাকে ডাক পাঠিয়েছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছি আমার যাবার দিন কাছে এসে গিয়েছে। কিন্তু বাবা যখন নিয়ে যাবেন বলেছেন তখন আর ভয় কি?
আমি চুপ করে বসে রইলাম?
দেবদর্শন বললেন—আপনাকে আমি পুরো চিনতে পারিনি ঠাকুরমশাই। যেমন অমরজীবনকেও না। কিন্তু এই ঘটনা আপনাকে না বলে গেলে আমি শান্তি পেতাম না। অমরজীবন কে ঠাকুরমশাই? আপনিই বা কে?
বললাম—আমি খুব সাধারণ রক্তমাংসের মানুষ। সাধনা করে কিছু শক্তি পেয়েছিলাম, এইমাত্র। কিন্তু অমরজীবনের প্রকৃত পরিচয় আমিও জানি না। না জানাই বোধহয় ভালো। আমরা বুঝতে পারবো না, কেবলমাত্র বিভ্রান্ত হবো। যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে। তবে হয়ত আবার সঙ্গে দেখা হবে।
দেবদর্শন চুপ করে আছেন। জানালার বাইরে বাতাবিলেবুর গাছটা, যার ডালে সেই আশ্চর্য পাখি এসে বসেছিল। এই বাড়ি জীবনদেবতার আশীর্বাদপূত, বোধহয় তাই সে পাখি কেবল এখানেই আসে। লক্ষ্মীর বাস ছিল এ বাড়িতে, এর প্রতিটি অলিন্দে দেবীর অধিষ্ঠান। মৃত্যু আসছে, কিন্তু সে আসছে শিউলিঝরা স্নিগ্ধতায়।
বাকি দিনটা ঘুরে বেড়ালাম জয়তলা গ্রামের পথে পথে। আর হয়ত কোনদিন এখানে। আসা হবে না—বিদায় চাইলাম গ্রামের মাটির কাছে। রাত্তিরবেলা বারান্দায় খেতে বসলাম। একা, দেবদর্শন চলতে পারেন না বলে আজকাল তার খাবার ঘরেই দেওয়া হয়। থালায় তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত, ছোট্ট বাটিতে বাড়ির তৈরি গাওয়া ঘি, মৃগেল মাছের ঝোল। আজ আর গিন্নিমা দাঁড়িয়ে তদারক করছেন না, বুড়ো রঘু যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। শেষ পাতে ঘন দুধ আর সুপক মর্তমান কলা।
জয়তলা গ্রাম সুখে থাকো। সুখে থাকো বাঙালী।
পরের দিন খুব ভোরে জয়তলা ছেড়ে চলে এলাম। রঘু গ্রামের সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে বলল–কর্তার খাওয়া ইদানিং একেবারে কমে গিয়েছিল। আপনি এসেছিলেন বলে ওঁর মন খুব খুশি, কাল দুবেলাই পেট ভরে খেয়েছেন।
আলপথে হেঁটে অর্ধেক মাঠ পার হয়ে একবার পেছন ফিরে দেখি তখনও বিশ্বস্ত, বৃদ্ধ মানুষটি তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
* * *
গল্প শেষ করে তারানাথ বলল—এ কাহিনীর এখানেই ইতি।
কিশোরী বলল—যাঃ, গল্প শেষ হয়ে গেল।
তারানাথ হেসে বলল—না, এই গল্পটা শেষ হয়ে গেল। আমি রইলাম, পৃথিবী রইল তার বৈচিত্র্য নিয়ে, অমরজীবন রইল। সবচেয়ে বড় কথা—তোমরা রইলে আমাকে দিয়ে। গল্প বলিয়ে নেবার জন্য। অবিলম্বে আবার শুরু করব।
একটু চুপ করে থেকে আমাদের দিকে তার উজ্জ্বল দুই চোখ তুলে বলল—তারপর একসময় তো থামতেই হবে। যখন আমার জানালায় এসে বসবে সেই আশ্চর্য পাখি।
–সমাপ্ত–